ইসলামি ব্যাংকিং কোন পথে?
ধর্মপ্রাণ রবিউল ইসলাম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। সুদ দেওয়া-নেওয়া তার ধর্মবিরোধী হওয়ায় অনেক বছর তিনি প্রচলিত ব্যাংকিং সেবা থেকে দূরে ছিলেন।
তার বেতনের টাকা একটি বেসরকারি ব্যাংকে আসলেও সেখান থেকে তিনি ঋণ বা অন্য সেবা নেন না।
প্রায় ১০ বছর আগে নিজের সঞ্চয়ের টাকা কোথায় রাখবেন সে বিষয়ে একজন ধর্মবিশেষজ্ঞ বা ইমামের পরামর্শ নেন। পরে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে অ্যাকাউন্ট খোলেন।
রবিউল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইসলামী ব্যাংকের সব ব্যাংকিং কার্যক্রম ধর্মীয় বিধি মেনে চালানো হয়—এমন নিশ্চয়তা পেয়েই আমি সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলি।'
তার মতো দেশের লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইসলামি ব্যাংকিংয়ে আগ্রহী হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
দেশে ইসলামি ব্যাংকিং ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে শুরু হয়। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এই ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিকশিত হতে থাকে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ দেশের প্রথম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংক মুনাফা ভাগাভাগির ভিত্তিতে বিনিয়োগ অ্যাকাউন্ট (মুদারাবাহ) ও অর্থায়ন সুবিধা (মুশারাকাহ) চালু করে।
২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে ইসলামী ব্যাংকের সাফল্যের ফলে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক গড়ে উঠে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ। এমনকি যারা ধর্মীয় অনুশীলন নিয়মিত মানতে পারেন না তারাও ইসলামি নীতি মেনে চলতে চান। ইসলামি ব্যাংকগুলো মানুষের এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগাচ্ছে।'
তার মতে, ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনেকেই সুদমুক্ত ব্যাংকিং পছন্দ করেন।
ইসলামি ব্যাংকগুলোর জনপ্রিয়তার আরেক কারণ হলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাদের অনুকূল নীতিগত সহায়তা। এটি এই খাতকে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশি লাভজনক করেছে।
প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় ইসলামি ব্যাংকিং খাতে বিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (এসএলআর) ও বিনিয়োগ-আমানত অনুপাত (আইডিআর) কম।
মোহাম্মদ নুরুল আমিনের অভিযোগ—যারা ঋণ, অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তারা আদর্শগত কারণে নয়, শুধু মুনাফার জন্য ইসলামি ব্যাংক গঠন করেছেন। আদর্শই যদি চালিকা শক্তি হয়, তাহলে এক ব্যক্তি কীভাবে ছয় থেকে আটটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের মালিক হন?
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে, প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে তাদের আমানতের ১৩ শতাংশ এসএলআর হিসেবে রাখতে হয়। ইসলামি ব্যাংকগুলোকে রাখতে হয় মাত্র সাড়ে পাঁচ শতাংশ।
একই সঙ্গে প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে এডিআর (অ্যাডভান্স টু ডিপোজিট রেশিও) ৮৭ শতাংশ ও শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে ৯২ শতাংশ এডিআর বজায় রাখতে হয়।
প্রচলিত ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা ও ইসলামি ব্যাংকগুলো ৯২ টাকা ঋণ দিতে পারে।
মোহাম্মদ নুরুল আমিন আরও বলেন, 'এ ধরনের নীতিগত সুবিধার কারণে বিনিয়োগকারী ও অংশীদাররা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনে আগ্রহী।'
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত সহায়তা লাভজনক হওয়ায় দেশে বেশকিছু প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকে পরিণত হয়েছে।
যেমন—প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ২০২১ সালে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়।
এই দুই ব্যাংকসহ দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক আছে। অন্যগুলো হলো—ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
দেশজুড়ে এসব ব্যাংকের প্রায় এক হাজার ৭০০ শাখা আছে।
তবে অধিকাংশ প্রচলিত ব্যাংককে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এছাড়া, অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং শাখা আছে। ফলে তারা অনেক গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে, যারা আগে এসব ব্যাংকের সেবা নিতেন না।
দেশে ১৫ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৩০ ইসলামি ব্যাংকিং শাখা আছে। এছাড়াও, ১৬ ব্যাংকের ৬২৪ ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো আছে।
এছাড়াও, কিছু ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা প্রতিষ্ঠান ইসলামি বন্ড (সুকুক), ইসলামি ইনস্যুরেন্স (তাকাফুল) ও ইসলামি ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছে।
'সুকুক' ব্যবস্থা অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা সংগ্রহের বিকল্প হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, 'তাকাফুল' ব্যবস্থা ব্যক্তি ও ব্যবসায়ের জন্য শরিয়াহভিত্তিক বিমা সেবা দিচ্ছে।
'সুশাসন বাড়াতে, ঝুঁকি আরও ভালোভাবে পরিচালনা করতে ও জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে নিয়ন্ত্রক, ব্যাংক ও অংশীদারদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।'
ইসলামি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসব প্রতিষ্ঠান জনগণকে আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে আনার পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনেও অবদান রাখছে।
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের প্রতি জনগণের ব্যাপক আগ্রহ থাকায় ২০২২ সাল পর্যন্ত এর অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি আসে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতে মোট আমানত চার লাখ ২১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকায় পৌঁছায়। বিনিয়োগ দাঁড়ায় তিন লাখ ৮৬ হাজার ২২১ কোটি টাকা। এছাড়া, আইডিআর দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৯২ ও অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত মার্চ পর্যন্ত ইসলামি ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৯ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। মোট বিনিয়োগের পরিমাণ চার লাখ ৫৬ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের হিসাবে, দেশের মোট ব্যাংকিং খাতের সম্পদের ২৫ শতাংশেরও বেশি ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার অধীনে আছে।
সাম্প্রতিক সংকট
প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি ও সম্ভাবনা সত্ত্বেও ঋণ অনিয়ম, কেলেঙ্কারি ও শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতির কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে এ খাত বড় ধরনের সংকটে পড়েছে।
২০২২ সালের শেষের দিকে শরিয়াহভিত্তিক এক ডজন ব্যাংকের সম্পদের মানের অবনতি ও বেশ কয়েকটি ঋণ অনিয়ম প্রকাশ্যে আসায় ইসলামি ব্যাংকিং খাত প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। এটি এই খাতের প্রবৃদ্ধি ও তারল্য সূচকে প্রভাব ফেলে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুসারে, ২০২২ সালে ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধি এর আগের বছরের তুলনায় দুই দশমিক নয় শতাংশে নেমে আসে। এক বছর আগে তা ছিল ২০ দশমিক এক শতাংশ।
বর্তমানে আমানতকারীরা তাদের টাকা তুলে নেওয়ায় শরিয়াহভিত্তিক ছয় ব্যাংক ব্যাপক তারল্য সংকটে পড়ে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে পুরো খাতে।
সম্প্রতি ফিচ রেটিংস জানায়, প্রচলিত ব্যাংকিং খাতের তুলনায় বেশি নাজুক হয়ে পড়ায় বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকিং খাত এখনো তারল্য সংকটে ভুগছে।
এই মার্কিন ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি আরও জানায়, বাজার বড় হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকিং খাত গত দুই বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে।
তারল্য সংকট এতটাই প্রকট যে, সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর অন্যতম আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে।
গত মার্চের শেষে এ খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমে হয়েছে এক হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। এটি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৯১ দশমিক তিন শতাংশ কম।
মোহাম্মদ নুরুল আমিনের অভিযোগ—যারা ঋণ, অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তারা আদর্শগত কারণে নয়, শুধু মুনাফার জন্য ইসলামি ব্যাংক গঠন করেছেন। আদর্শই যদি চালিকা শক্তি হয়, তাহলে এক ব্যক্তি কীভাবে ছয় থেকে আটটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের মালিক হন?
কাঠামোগত সমস্যা
এ খাতের কিছু কাঠামোগত সমস্যা আছে। শরিয়াহ মেনে চলা সেবার সংখ্যা কম। ব্যাংকগুলোকে তলবি মুদ্রা বাজার থেকে ঋণ নিতে হওয়ায় তারল্য সংকট আরও বেড়েছে।
এ ছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা কিছু নীতিমালা ছাড়া দেশে ইসলামি ব্যাংকিং খাতের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন নেই। যদিও অন্যান্য দেশে এই খাতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক শরিয়াহ ব্যাংকিং দিকনির্দেশনা সংশোধন করলেও এখনো তা প্রকাশ করেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি সম্প্রতি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু দিকনির্দেশনা সংশোধনই যথেষ্ট না। নিয়ম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।'
তিনি মনে করেন, নিয়ম না মানায় বেশিরভাগ ইসলামি ব্যাংকের অবস্থা আগের তুলনায় খারাপ।
সংশ্লিষ্টরা প্রচলিত ব্যাংকিং ও ইসলামি আইন বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে ব্যাংকগুলোয় তদারকি কমিটি গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়—ব্যাংক কর্মকর্তাদের ইসলামি শরিয়াহ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব। পাশাপাশি, ইসলামি পণ্ডিতদের ব্যবহারিক ব্যাংকিং সম্পর্কে ধারণা তুলনামূলক কম।
এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নিয়ন্ত্রণ দরকার বলেও মনে করছেন তারা।
এগিয়ে যাওয়ার পথ
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সংকট মোকাবিলা ও টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সুশাসন ও জবাবদিহিতা মূল চাবিকাঠি।
এর জন্য অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীন নিরীক্ষা ও স্বচ্ছ রিপোর্টিং পদ্ধতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি ইসলামি নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যতা দেখতে শরিয়াহ বোর্ডের ভূমিকা ও স্বাধীনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক পর্যালোচনা করা এবং প্রয়োজনে ওই ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরিয়াহভিত্তিক এক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সুশাসন বাড়াতে, ঝুঁকি আরও ভালোভাবে পরিচালনা করতে ও জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে নিয়ন্ত্রক, ব্যাংক ও অংশীদারদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।'
তিনি আরও বলেন, 'কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে ইসলামি ব্যাংকিং আইন প্রয়োজন। বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠে এ খাত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।'
Comments