সি পার্লের শেয়ারে সিটি ব্যাংকের ৮৫ কোটি টাকার প্রশ্নবিদ্ধ বিনিয়োগ

সি পার্লের শেয়ারে সিটি ব্যাংকের বিনিয়োগ

সিটি ব্যাংক পিএলসি ২০২৩ সালে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের শেয়ার কিনতে প্রায় ৮৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বড় রকমের লোকসানের মুখে আছে। এটি শেয়ারবাজারে ব্যাংকটির মোট বিনিয়োগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। সিটি ব্যাংক কীভাবে ও কেন সি পার্ল রিসোর্টে এই বিনিয়োগ করল তা ব্যাংক নিজেই তদন্ত করছে।

তদন্তে দেখা গেছে, কক্সবাজারভিত্তিক হোটেল কোম্পানিটি বন্ড (ঋণ) পরিশোধে খেলাপি হওয়ার পর্যায়ে গিয়েছিল। এরপরও প্রতিষ্ঠানটিতে সিটি ব্যাংক কেন বিনিয়োগ এত বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করলো, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, বাজারে কারসাজির মধ্যে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বেশি হলে তখন সিটি ব্যাংক এই কোম্পানির শেয়ার কিনেছিল। এখন শেয়ারের দাম কমে গেছে, ফলে তাদের বিনিয়োগ এখন লোকসানের মুখে।

২০২৩ সালের শেষ নাগাদ সি পার্লের শেয়ারের দাম ৫১ শতাংশ কমে যায়, ফলে সিটি ব্যাংকের বিনিয়োগমূল্য ৪২ কোটি টাকায় নেমে আসে। আর এখন শেয়ারের দাম আরও কমে, এই 86 কোটি টাকা বিনিয়োগের বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে। এই তথ্য দেখে বোঝা যায়, সিটি ব্যাংকের বিনিয়োগের বাজার মূল্য প্রায় ৭৩ শতাংশ কমেছে।

ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সি পার্লের পর সিটি ব্যাংকের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ আছে আইডিএলসি ফাইন্যান্সে, যার পরিমাণ ৪৬ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, সিটি ব্যাংক কেন এমন একটি কোম্পানির এত শেয়ার কিনবে?

তারা বলছেন, সিটি ব্যাংকের সি পার্লে বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের কারণে বাজার কারসাজিকারিরা বেশি দামে শেয়ার বিক্রির সুযোগ পেয়েছিল।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, সাধারণত ব্যাংকগুলোর মূল কাজ হলো ঋণ বিতরণ করা। এর পাশাপাশি তারা বাড়তি মুনাফা অর্জনের জন্য পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে।

তিনি বলেন, 'কিন্তু বিনিয়োগের মাধ্যমে এত বড় ক্ষতি হলে, তা মেনে নেওয়া যায় না।'

সিটি ব্যাংক বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণে ব্যর্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ব্যাংকটি অন্য কাউকে সুবিধা দিতে শেয়ার কিনেছে কিনা তা নিয়ে এখন যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে।'

অন্যদিকে সি পার্লের শেয়ারের অস্বাভাবিক দর ওঠানামা খতিয়ে দেখতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস ও কয়েকজন ব্যক্তি কোম্পানিটির শেয়ারের দাম নিয়ে কারসাজিতে জড়িত বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে অভিযোগ তোলা হয়েছিল।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেয়ারের দামে কারসাজির সময় সি পার্লের শেয়ার কেনা আরও কয়েকটি ব্যাংক মোটা অংকের মুনাফা করলেও কিছু লোকসানে পড়েছে।

কিন্তু ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত শেয়ারের মালিকানা না থাকায় ব্যাংকগুলোর আর্থিক বিবরণীতে এ তথ্য ছিল না।

বিএসইসির মধ্যম পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, গুজব ও কারসাজির ওপর ভিত্তি করে শেয়ারের দর বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের শুধু সতর্কবার্তাই দিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করে। এর আগে কয়েক বছর ধরে সি পার্লের শেয়ারের দাম ৫০ টাকার নিচে ছিল। অথচ এক বছর পর ৩০৮ টাকায় পৌঁছায়।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা কমে ৪৬ টাকায় দাঁড়ায়।

সিটি ব্যাংকের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সি পার্লে তাদের ৪২ লাখ শেয়ারের প্রতিটির জন্য গড়ে ২০৩ টাকা ব্যয় করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, কোনো অবস্থাতেই ব্যাংক এ ধরনের শেয়ার কিনতে পারে না, কারণ যেসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয় তাতে কাউকে না কাউকে শেষ পর্যন্ত লোকসানে পড়তে হয়।

তিনি প্রশ্ন করেন, 'একটি ব্যাংক কেন তার আমানতকারীদের অর্থ দিয়ে এই শেয়ার কিনবে?'

এদিকে সি পার্লের অডিটর তাদের অডিট রিপোর্টে মতামত দিয়েছেন যে, তারা ২০২২-২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে কিছু বস্তুগত ভুল তথ্য খুঁজে পেয়েছেন।

হোটেলটির দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, স্বল্পমেয়াদি ঋণ, বন্ড পেমেন্ট, লিজ ফাইন্যান্স ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য পাওনা মিলিয়ে ৫৬৫ কোটি টাকার মতো ঋণের মধ্যে রয়েছে।

নিরীক্ষক তার প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কোম্পানিটির মোট ঋণ তাদের মোট ইক্যুইটির ৭১ দশমিক ১৮ শতাংশ।

এছাড়া ২০২০ সালের জুন থেকে বন্ডের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না কোম্পানিটি। এ কারণে এর দায় অনেক বেড়েছে বলে জানান নিরীক্ষক।

২০১৭ সালে ব্যবসা বাড়াতে ২০ শতাংশ কনভার্টিবল বন্ডের মাধ্যমে ৩২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে সি পার্ল। ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বন্ডের সবগুলো ইউনিটই ক্রয় করে।

কিন্তু সময়মতো সি পার্ল বন্ডের সব কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়। পরে তারা হাইকোর্টে ব্যবসায় মন্দা ও পরবর্তীতে আইসিবিকে অর্থ পরিশোধ না করতে পারার জন্য করোনা মহামারিকে দায়ী করে।

পরে সি পার্ল বন্ডের ১২০ কোটি টাকা সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরের অনুরোধ জানায়। পরে গত ফেব্রুয়ারিতে বিএসইসি সি পার্লকে খেলাপি হতে রক্ষা করতে এ বিষয়ে অনুমোদন দেয়।

এ ধরনের একটি কোম্পানিতে কেন বিনিয়োগ করা হলো এ ধরনের প্রশ্নের একটি লিখিত উত্তরে সিটি ব্যাংক বলেছে, সি পার্লের শেয়ার প্রতি আয় আগের বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে ১০ গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে জানার পর এই শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এছাড়া শামীম এন্টারপ্রাইজের (প্রা.) ৩০ শতাংশ শেয়ার কেনার পরিকল্পনা করে সি পার্ল। এখান কোম্পানিটি বছরে ১৮ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা পাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।

এটি আরও ঘোষণা করেছিল, জেম গ্লোবাল ইল্ড এলএলসি সি পার্লের শেয়ার কিনবে এবং সংশ্লিষ্ট ক্রয় চুক্তিটি বিএসইসি ও ডিএসই অনুমোদন দিয়েছিল।

সিটি ব্যাংক বলছে, 'বিনিয়োগের সময় আমরা দেখেছিলাম, শেয়ারবাজারে সি পার্ল সবসময় লেনদেনের শীর্ষ ২০ কোম্পানির মধ্যে ছিল। এ কারণে আমরা এটিকে ওই সময়ে সবচেয়ে লিকুইড শেয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছি।'

কিন্তু প্রায় এক বছর পার হয়ে গেলেও জেম গ্লোবাল এখন পর্যন্ত সি পার্লের শেয়ার কেনেনি।

এদিকে এই শেয়ার কেনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ জুলাই সিটি ব্যাংক এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে।

সিটি ব্যাংক আরও জানায়, তারা স্বনামধন্য ব্রোকারেজ হাউজ ইউনাইটেড সিকিউরিটিজকে পুঁজিবাজার বিনিয়োগ তহবিল ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তারা এ শেয়ার কেনার পরামর্শ দেয়।

ইউনাইটেড গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড সিকিউরিটিজ এক লিখিত জবাবে জানায়, একটি ব্রোকারেজ হাউজ শুধু ব্রোকারেজ সেবা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে আছে গ্রাহকদের তথ্য গবেষণা, বিশ্লেষণ ও বাজার মনোভাব সরবরাহ করা হয়।

ইউনাইডেট সিকিউরিটিজ বলেছে, 'সি পার্লের শেয়ার অফলোড করতে চায় এমন কোনো কারসাজির বিষয়ে ইউনাইটেড সিকিউরিটিজের কোনো ধারণা বা জানা ছিল না। শেয়ার কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট কমিটি নিয়েছে।'

একটি শীর্ষ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, জেম গ্লোবালের কাছে শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা কেন বাস্তবায়ন হয়নি তা বিএসইসির খতিয়ে দেখা উচিত।

এদিকে সি পার্ল বেশি লাভের পূর্বাভাস দিলেও হোটেলটির আয় আসলে কমেছে। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিটির নিট মুনাফা ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ৪৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বিএসইসির মুখপাত্র ফারহানা ফারুকী বলেন, জেম গ্লোবালের কাছে শেয়ার বিক্রির জন্য কমিশন কিছু শর্ত দিয়েছিল, কোম্পানিটি তা পূরণ করেনি, তাই বিক্রি সম্পন্ন হয়নি।

তার ভাষ্য, 'যেহেতু হোটেলটি গত এক বছরে তার শেয়ার বিক্রি সম্পন্ন করতে পারেনি, তাই বিক্রির সর্বশেষ অবস্থা জানাতে আরও একটি ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিল।'

এ প্রতিবেদন লেখার সময় সি পার্লের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল হকের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। তাই তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

অর্থনীতিবিদ তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, একটি ব্যাংকের উচিত ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা। 'অন্যথায় তারা লাভের পরিবর্তে লোকসানে পড়বে।'

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

3h ago