‘ব্যাংকের কোথায় খারাপ’ না জানা অর্থমন্ত্রীকে কে দেবেন ‘লিখিত’

ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা সন্দেহজনক ঋণ নেওয়া হয়েছে। ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে এই ঋণ নেওয়া হয়েছে বলে গত ২৪ নভেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত 'ইসলামী ব্যাংকে ভয়ংকর নভেম্বর' শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। এর মধ্যে শুধু ইসলামী ব্যাংকে থেকেই প্রায় ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, 'ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ, লিখিত দিয়ে যান, আমরা খতিয়ে দেখব।'

আজ ইংরেজি দৈনিক নিউ এজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। নিয়ম অনুযায়ী গ্রুপটি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এই ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সন্দেহ, এস আলম গ্রুপ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলো থেকে নিজ প্রতিষ্ঠান ও তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বেশিরভাগই ইসলামী ব্যাংক থেকে নেওয়া।

ইসলামী ব্যাংকের ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ তদন্তে গত সোমবার কমিটি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নাবিল গ্রুপসহ ৮ প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ ছাড় বন্ধ রাখতে বলেছে কমিটি।

এই যে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ঋণ নেওয়া হলো, ব্যাংক কি ঋণ দেওয়ার আগে সেসব যাচাই-বাছাই করেনি? দেশে ডলার, টাকা, গ্যাস, জ্বালানিসহ নানা ধরনের সংকট চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি। সরকার দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে জনগণকে কৃচ্ছ্রতাসাধনের কথা বলছে। অন্যদিকে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার টাকার সন্দেহভাজন ঋণ আলোচনায় এলো। সরকার কি তাহলে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না নাকি চাইছে না? আবার প্রতিবেদন প্রকাশের পরেও অর্থমন্ত্রী লিখিতভাবে দিতে বলেছেন। তার মানে অর্থমন্ত্রী কি আসলেই জানেন না যে ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ?

দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদের সঙ্গে।

তাদের মতে, এসব ঘটনার পেছনের অবশ্যই সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় আছে। অন্যথায় বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ নেওয়া যেত না।

অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়ার জন্যই অর্থমন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করেছেন উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, 'এ ধরনের অত্যন্ত বাজে মন্তব্য করে তিনি সমস্যা এবং সেগুলো সমাধানের পথ আরও জটিল করে দিচ্ছেন। এসব মন্তব্য কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। তার দায়িত্ব অন্যরা পালন করবে, সেটা তিনি কীভাবে আশা করেন? ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ সেটা বের করার দায়িত্ব তো তার। সেটা সাংবাদিকরা কেন লিখিত দেবে? এর আগে পুঁজিপাচারের ঘটনাও তিনি লিখিতভাবে দিতে বলেছিলেন। নিজের দায়িত্ব পালন না করে অন্যকে এসব কথা বলার কোনো মানে হয় না।'

সন্দেহজনক ঋণ নিয়ে তিনি বলেন, 'যে ৩টি ব্যাংক নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে, সবগুলোই এস আলম গ্রুপের হাতে। বলতে গেলে এগুলো তাদেরেই ব্যাংক। এখন এ ঋণের সঙ্গে এস আলম গ্রুপ জড়িত আছে কি না, সেটা না জেনে আমি মন্তব্য করতে চাই না। একটা গ্রুপের আওতায় যদি ৭টি ব্যাংক থাকে, তাহলে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এ বিষয়ে সরকার কিছু করছে না কেন, সেটা বুঝি না। ঋণের বিষয়টি তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত হলে এখানে কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার আছে।'

'এস আলম যদি এ ঋণগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, তাহলে সেখানে সন্দেহজনক কিছু থাকা অস্বাভাবিক নয়। সরকারকে সাবধান হতে হবে যে, একটা গ্রুপের হাতে ৭টি ব্যাংক থাকা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। এ বিষয়ে অতিদ্রুত সরকারকে কিছু করতে হবে এবং এ ব্যাংকগুলোকে তাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে। একটা গ্রুপ যদি এতগুলো ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে যেকোনো সময় সেটা অর্থনীতির জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে', বলেন তিনি।

সরকার এখনো কিছু করছে না কেন?, জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, 'সেটাই তো আমরা জানি না যে, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে তাদের কী সম্পর্ক। একটা তো সম্পর্ক আছেই। তা না হলে এতগুলো ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে দিলো কীভাবে সরকার?'

অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য 'দায়িত্বজ্ঞানহীন' উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, 'যারা এভাবে ঋণ নিচ্ছে, তাদের রক্ষা ও আড়াল করাটাই অর্থমন্ত্রী নিজের দায়িত্ব হিসেবে মনে করছেন। যেসব তথ্য সামনে আসছে, সাংবাদিকরাই সেগুলো দিচ্ছে। কিন্তু, এসব তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব অর্থমন্ত্রীর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের, বাংলাদেশ ব্যাংকের ও সরকারের। এখন এসব বিষয়ে যদি তাদের বোধোদয় না হয়, তারা যদি দেখেও না দেখার ভান করে, অস্বীকার করে এবং দেখতে না চায়, এতেই প্রমাণ করে যে, যারা এভাবে ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলোর ক্ষতি করছে, অর্থপাচার করছে, তারা সরকারের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদ নিয়েই কাজগুলো করছে এবং সরকার ও অর্থমন্ত্রী এই লুটেরাদের প্রধান অংশীদার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায়।'

ব্যাংক থেকে এভাবে ঋণ নেওয়ার ঘটনা সুপরিকল্পিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'দেশের ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলেও অনেক নিয়ম-কানুন মানতে হয়। ১ লাখ টাকা ঋণ নিতে গেলেও ব্যাংকে এনআইডিসহ প্রয়োজনীয় অনেক কাগজপত্র জমা দিতে হয়। ব্যাংক সেসব যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিয়ে থাকে। সেরকম একটা অবস্থায় হাজারো কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হচ্ছে, অথচ তাদের নাম-ঠিকানার ঠিক নেই। যেকোনো বড় অঙ্কের ঋণ নিতে গেলে অনুসন্ধান হয়। ব্যাংকের নির্দিষ্ট টিম আছে এর জন্য। সে টিম সব যাচাই-বাছাই করে তারপর ঋণ অনুমোদন দেবে, যাতে ঋণ ফেরত আসার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। কিন্তু, আমরা দেখেছি যে, অনামি কিংবা সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সহজেই বোঝা যায় যে, এগুলো সুপরিকল্পিত।'

'ব্যাংকে যারা নীতি-নির্ধারক এবং তাদের যারা নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন: বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়— সবার যোগসাজশ না থাকলে এ ধরনের কাজ একের পর এক হওয়া সম্ভব নয়। বছরের পর বছর এ ধরনের ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সর্বশেষ ইসলামী ব্যাংকে যে ঘটনা ঘটল, এখানে বিষয়টি আরও পরিষ্কার যে মালিকানা পরিবর্তন ও যথেচ্ছ নিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে যেভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে, এতে বোঝা যায় যে, জনগণের টাকার যথেচ্ছা বিতরণ-লুণ্ঠন হয়েছে। এটা উদ্দেশ্য হিসেবেই ছিল। এটা আকস্মিক বা অনিচ্ছাকৃত নয়', বলেন তিনি।

সরকারের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অনিয়ন্ত্রিত লুণ্ঠন ও সেই অর্থ বিদেশে পাচার দেশে ডলার সংকটের অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ। 'কৃচ্ছ্রতাসাধন বা দুর্ভিক্ষসহ নানা ধরনের যে কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো ক্ষমতাহীন নাগরিকদের জন্য। আর ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে ঋণখেলাপি হওয়া বা সম্পদ পাচার করা, আমলাদের বিদেশ সফর, মন্ত্রী-সচিবদের সম্মিলিত ভোগবিলাস, সব কিছুই চলছে। এখানে কৃচ্ছ্রতাসাধন নেই। তার মানে হলো একটা সংকটের কথা বলে জনগণকে নিরস্ত করা, যাতে জনগণ তাদের অধিকার না পায়। যেমন: বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যে দাম বাড়িয়েছে। এগুলোকে রেশনালাইজ করতে কিংবা জনগণ যাতে এগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ না হয়, সেজন্যই যুদ্ধসহ নানা কিছু বলে কৃচ্ছ্রতাসাধনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু, এ অবস্থার আড়ালে সরকারের ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী ঠিকই অধিক হারে লুণ্ঠন ও সম্পদ পাচার করছে। ঋণখেলাপিদের যে টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে বেনামে যে টাকাটা তোলা হয়েছে, এই টাকা তো দেশে নেই, বিদেশে চলে গেছে। ডলার করে এগুলো বিদেশে পাঠানো হয়েছে। সেগুলো আড়ালের জন্যই কৃচ্ছ্রতাসাধনের কথা বলা হচ্ছে।'

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা 'সন্দেহজনক' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকে পরপর ২ জন আমলাকে গভর্নর বানানো হয়েছে। আমলাদের দায়িত্ব বা কাজের ধরন হচ্ছে, তারা উপরের আদেশ পালন করে। গত কিছুদিনে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো পরিচালনার দায়িত্ব কিছু গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, কোনো ধরনের মনিটরিং নেই এবং ঋণখেলাপিদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিভিন্ন নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তাতে এটা ধরে নেওয়ার কারণ আছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক উপরের আদেশে আদিষ্ট হয়ে একটা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে এবং আদিষ্ট হয়ে তারা এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে দিচ্ছে। কারণ, শত বা হাজারো কোটি টাকার যে সন্দেহজনক ঋণ, এটা নেওয়ার প্রক্রিয়া তো ১ বা ২ দিনে হয়নি।'

'বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব এগুলো নিয়মিত মনিটরিং করা এবং অনিয়ম থাকলে তা সংশোধন-নিয়ন্ত্রণ করা এবং অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু, আমরা দেখছি, তাদের চোখের সামনেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে', বলেন তিনি।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ঋণ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করতে হয়। তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে কি না, এর আগে ঋণ নিয়ে সেটা পরিশোধ করেছিল কি না, এগুলোসহ নানা ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর। কিন্তু, শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, সোনালী ও জনতাসহ প্রায় সব ব্যাংকই অনেক সময় ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে না। এর পেছনে দায়ী ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ও পরিচালনা পর্ষদ। আর সর্বোপরি দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিংয়ের দুর্বলতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে যারা অন-সাইট ও অফ-সাইট সুপারভিশন এবং অডিট করে, এক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা আছে।

এসবের পেছনে সরকারেরও দায় আছে উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, 'অনেক সময় তো সমস্যাটা চিহ্নিত। কিন্তু, সরকারের সংশ্লিষ্টরা যথাযথভাবে ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে না। যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে, তাহলে এসব সমস্যা সমাধান করা যায়।'

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

30m ago