বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ইজারা দেওয়া নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক তীব্র হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও বামপন্থী দলসহ বিভিন্ন মেরুর বেশকিছু রাজনৈতিক সংগঠন।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সেটি এগিয়ে নিচ্ছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠন এর বিরোধিতা করলেও, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়ার বিষয়ে মতামতের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের নিযুক্ত আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থা এখন কাজ করছে। শিগগির তাদের মতামত পাওয়া যাবে। সেই মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ইঙ্গিত দিয়েছেন, সরকার টার্মিনালটি পরিচালনার ভার বিদেশি অপারেটরকে দেওয়ার পক্ষে।

বিরোধীদের যুক্তি—টার্মিনালটি সুসজ্জিত। বাইরের কারও সম্পৃক্ততা ছাড়াই বিশ্বমানের পরিষেবা দিতে সক্ষম। তাদের দাবি, টার্মিনালটি বড় করার সুযোগ নেই। বিদেশি বিনিয়োগ 'অপ্রয়োজনীয়' ও বিদেশি অপারেটর নিয়োগ 'অযৌক্তিক'।

২০০৭ সালে ৪৬৯ কোটি টাকা খরচে শেষ হওয়া ৯৫০ মিটার দীর্ঘ টার্মিনালে পাঁচটি জেটি আছে। চারটি জেটি সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য এবং একটি অভ্যন্তরীণ রুটে ছোট জাহাজের জন্য।

'চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) টার্মিনালকে পুরোপুরি কার্যকর করতে দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে' জানিয়ে বিএনপির শ্রমিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের (বন্দর শাখা) সাবেক প্রচার সম্পাদক হুমায়ুন কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন বিনিয়োগের জায়গা খুব একটা নেই।'

২০০৭ সাল থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড টার্মিনালের দুটি জেটি অস্থায়ী ভিত্তিতে পরিচালনা করে আসছিল। ২০১৫ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে সাইফ পাওয়ারটেককে চারটি জেটি পরিচালনায় নিয়োগ দেয়।

সাইফ পাওয়ারটেকের কাজ পাওয়ার বিষয়টি তৎকালীন সরকারের 'স্বজনপ্রীতিমূলক' বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, বর্তমান সরকারের উচিত প্রতিযোগিতামূলক স্বচ্ছ দরপত্রের মাধ্যমে নতুন নতুন অপারেটর নিয়োগ দেওয়া।

বিদেশি অপারেটরের কাছে টার্মিনাল ইজারা দেওয়ার বিরোধিতা করে হুমায়ুন কবির বলেন, 'বিদেশি অপারেটরের কাছে কর্মব্যস্ত টার্মিনালটি ইজারা দিলে এ থেকে রাজস্ব আয় দেশের বাইরে চলে যাবে।'

বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই টার্মিনাল থেকে এক হাজার ২১৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে বন্দরের প্রকৃত আয় হয়েছিল ৫৭৪ কোটি টাকা। খরচের মধ্যে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বাবদ সাইফ পাওয়ারটেক পেয়েছিল ৭৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

একই আশঙ্কার কথা বলেছেন জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম নগর শাখার প্রধান শাহজাহান চৌধুরী।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা বিদেশি বিনিয়োগের বিপক্ষে নই। নতুন প্রকল্প, বন্দর ও টার্মিনালের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ আনা যেতে পারে। চালু থাকা টার্মিনালের জন্য নয়।'

প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল ও লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল তৈরি ও পরিচালনার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পিএসএ সিঙ্গাপুর, ডিপি ওয়ার্ল্ড, এপি মোলার মায়ের্স্ক ও আবুধাবি বন্দরসহ আন্তর্জাতিক অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে।

২০২৩ সালে পূর্ববর্তী সরকার নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালটি (পিসিটি) সৌদি প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) ইন্টারন্যাশনালকে ২২ বছরের জন্য ইজারা দেয়।

তবে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জড়িত এসব উদ্যোগ এতটা বিরোধিতার মুখে পড়েনি।

বিদেশি বিনিয়োগে জোর

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনকালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বন্দর ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক অপারেটরদের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। বাংলাদেশকে বিশ্ব উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরতে তা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'সীমিত পরিসর সত্ত্বেও প্রতিটি বন্দরে বিশ্বমানের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারব না।'

চবক চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানও এই উদ্যোগকে সমর্থন করে বলেন, 'আন্তর্জাতিক অপারেটর উন্নত প্রযুক্তি ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে পারবে।'

তিনি মনে করেন, 'বিদেশিদের নিয়োগ দিলে বন্দরের কার্যক্রম আধুনিকায়ন হবে এবং পাশাপাশি আয়ের পরিমাণও বাড়বে।'

রাজনৈতিক চাপে বাতিল হওয়া পরিকল্পনা

২০০৭ সালে টার্মিনাল তৈরির কাজ শেষ হওয়ার দুই বছরের মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়ের শর্তে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে।

কিন্তু তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরীর হস্তক্ষেপে দরপত্র বাতিল হয়। এতে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় করে দেশীয় বেসরকারি অপারেটরকে (সাইফ পাওয়ারটেক) কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় টার্মিনালটি প্রায় আট বছর পূর্ণ সক্ষমতায় ব্যবহার করা যায়নি। টার্মিনালের জন্য মূল যন্ত্র গ্যান্ট্রি-ক্রেন কেনা শেষ হয় ২০২২ সালে।

২০২২ সালে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের আলোচনা শুরু হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এটি ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে ইজারা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন।

২০২৩ সালের মার্চে তৎকালীন সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় টার্মিনালটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক বেসরকারি অপারেটর নিয়োগের অনুমোদন দেয়।

Comments

The Daily Star  | English

Parties agree on 10yr PM term limit, independent police commission

Consensus disclosed by Commission Vice-Chairman Ali Riaz on 19th day of political dialogues at Foreign Service Academy

33m ago