ডলার সংকটে কমেছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লভ্যাংশ
দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২৩ সালে ভালো মুনাফা করলেও ডলার সংকটের কারণে অধিকাংশের শেয়ার লভ্যাংশ দেওয়ার পরিমাণ কমেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত ১২ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নয়টি বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে সাত প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ আগের বছরের তুলনায় কম।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট মুনাফা গত বছর ১০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে সাত হাজার ২৯ কোটি টাকা। তারা পাঁচ হাজার ৬০ কোটি টাকা লভ্যাংশ দিয়েছে। এটি মোট মুনাফার ৭২ শতাংশ।
২০২২ সালে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো লভ্যাংশ দিয়েছিল ছয় হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এটি ছিল মুনাফার ৯৫ শতাংশ।
রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়ায় গত দুই বছর ধরে ডলার সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। ডলারের বিপরীতে টাকার আরও দরপতন ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি সীমিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত বুধবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২১ সালের আগস্টে তা ছিল ৪০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশে রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে তা ছিল ৩৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
ডলার সংকটের কারণে আমদানিকারক, বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া শিক্ষার্থী ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার অর্থ তাদের মালিকদের কাছে পাঠাতে হয়।
দেশের তালিকাভুক্ত সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কম লভ্যাংশ দেওয়ায় বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিতে উদ্বুদ্ধ হন। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম কমে যায়। এটি পুরো বাজারে প্রভাব ফেলে।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করা কর্মীরা এমন হতাশাজনক লভ্যাংশ দেওয়ার জন্য দেশের কম রিজার্ভকে দায়ী করেছেন।
একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার মনে হয়, পরিচালকরা ভালো করেই জানেন যে ডলার সংকটের কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠান বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ পাঠাতে ঝামেলায় পড়ছেন।'
'বেশি লভ্যাংশ ঘোষণার কারণে যে ঝামেলা হয় পরিচালকরা তা নিতে চান না। কারণ শেষ পর্যন্ত তাদের অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠানো কঠিন হয়ে পড়বে।'
তিনি আরও বলেন, 'তারল্য ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠান রিজার্ভে কিছু অর্থ রাখতে চায়। আগামীতে আমাদের অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতে পারে।'
অপর এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে পরিচালনা পর্ষদ মোটা লভ্যাংশ ঘোষণা করে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে।'
ম্যারিকো বাংলাদেশের ডিভিডেন্ড পে-আউট হার এক বছর আগের ৭১ শতাংশ ও ২০২১ সালে ৯১ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ৬১ শতাংশে নেমে আসে।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ'র ক্ষেত্রে তা ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২২ সালে এটি ছিল ৬০ শতাংশ ও এর আগের বছর ছিল ৯৯ শতাংশ।
গ্রামীণফোন ২০২৩ সালে মুনাফার ৫১ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে দিয়েছিল। এটি আগের দুই বছরে দেওয়া ৯৯ শতাংশের তুলনায় অনেক কম।
রবি আজিয়াটা, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ ও সিঙ্গার বাংলাদেশও কম লভ্যাংশ দিয়েছে। অন্যদিকে, ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার ও আরএকে সিরামিকস বেশি লভ্যাংশ দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের বেশিরভাগই বিদেশি, তাই বাংলাদেশে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডলারে লভ্যাংশ পাঠাতে হয়।'
'ডলার সংকটের মধ্যে গত দুই বছর বিদেশে মুনাফার অর্থ পাঠানো ঝামেলাপূর্ণ ছিল। প্রত্যাশার তুলনায় কম লভ্যাংশ স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের আশাহত করেছে।'
বিশ্লেষকদের ভাষ্য, বিনিয়োগকারীরা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পছন্দ করেন কারণ তারা বেশি লভ্যাংশ দেয়। এখন তারা হতাশ, তাই তারা সেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।
ডিএসইর তথ্য অনুসারে, গতকাল ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো'র শেয়ার ৩৯৭ টাকা ও গ্রামীণফোন'র শেয়ার ২৩৫ টাকায় লেনদেন হয়। এটি গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার, ম্যারিকো, বার্জার পেইন্টস ও বাটা শু'র শেয়ারগুলোও গত দুই বছরের মধ্যে প্রায় সর্বনিম্ন দামে হাত বদল হয়েছে।
অধ্যাপক আবু আহমেদ আরও বলেন, 'রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হলে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী বছরগুলোয় বেশি লভ্যাংশ দিতে পারে। তাই বিনিয়োগকারীদের হতাশ হলে চলবে না।'
তার মতে, পুনর্বহাল করা আয় ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এটি ব্যাংক আমানতের তুলনায় বেশি রিটার্ন দিচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে মুনাফা বাড়াতে অবদান রাখতে পারে।
তিনি মনে করেন, যদি রিজার্ভ খুব স্বস্তিকর পর্যায়ে না যায় এবং ডলার সংকট আগামীতে না কমে তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনো বেশি লভ্যাংশ দিয়ে যাওয়া উচিত। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া লভ্যাংশ ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
Comments