লোহিত সাগরে হুতি আতঙ্ক: তৈরি পোশাক পরিবহনে খরচ বাড়ছে

গতকাল ২৭ জানুয়ারি এডেন উপসাগের একটি জাহাজে মিসাইল হামলা চালায় হুতিরা। ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনের জন্য আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাক বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো এখনো আকাশপথের পরিবর্তে সমুদ্রপথকে ব্যবহার করছে। যদিও জাহাজগুলোকে লোহিত সাগর থেকে বহুদূর ঘুরে যেতে হচ্ছে। এতে পরিবহনের খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। বাড়তি সময় লাগছে ১৫ দিন।

বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত জলপথ লোহিত সাগরে চলমান সংঘাতের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ওপরও। বিশ্বব্যাপী বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকি এড়াতে সাড়ে তিন গুণের বেশি প্রিমিয়াম নিচ্ছে।

লোহিত সাগরে সুয়েজ খালের মাধ্যমে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এশিয়া। বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ লোহিত সাগর দিয়ে হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী কন্টেইনারের প্রায় ৩০ শতাংশ এই জলপথ দিয়ে পরিবহন করা হয়।

গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত জাহাজগুলোয় হামলা শুরুর পর এটি বৈশ্বিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের হুতিদের ওপর পাল্টা হামলা জোরদার করায় সংকট আরও গভীর হয়।

লোহিত সাগর এড়িয়ে চলার কারণে জাহাজগুলোকে দীর্ঘ পথ ঘুরে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ পাড়ি দিতে হচ্ছে। প্রতিটি জাহাজকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার বাড়তি চলাচল করতে হচ্ছে এবং এর জন্য বাড়তি সময় লাগছে ১০ থেকে ১২ দিন।

অতিরিক্ত জ্বালানির পাশাপাশি জাহাজগুলোকে সম্ভাব্য বিকল্প বন্দর খোঁজা, পণ্য সরবরাহের সময়সূচি ও ক্রমবর্ধমান খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে হচ্ছে।

উড়োজাহাজে পণ্য পরিবহন অনেক ব্যয়বহুল। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের ক্রেতাদের পকেট থেকেই বাড়তি খরচ মেটাতে হবে। তারা বর্তমানে খরচ বাড়াতে প্রস্তুত নন। দীর্ঘদিন ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের ক্রয় ক্ষমতা ইতোমধ্যে কমেছে।

আকাশপথে পণ্য পরিবহনের কারণে বেশি কার্বন নিঃসরণ হলে পোশাকের আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোকেই বেশি ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলেও তারা উড়োজাহাজে পণ্য পরিবহন এড়িয়ে চলছে।

ঢাকা থেকে ইউরোপের বিমানবন্দরগুলোয় এক কেজি পণ্য পরিবহনের জন্য এয়ারলাইনসকে আড়াই ডলারের বেশি দিতে হয়। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রপথে একই জায়গায় যেতে খরচ হয় ৩০ সেন্ট।

সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের বন্দরে পৌঁছাতে সময় দেওয়া হয় ৩০ দিন। গত অক্টোবরের শেষের দিক থেকে আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে জাহাজগুলো ঘুরে যাওয়ায় তা ৪৫ দিন লাগছে।

বাংলাদেশ থেকে বছরে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি দামের পোশাক কেনা এক ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অতিরিক্ত ১৫ দিন ও ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত পরিবহন খরচ দরকার হচ্ছে। তবুও আমরা নৌপথে বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিচ্ছি।'

ওই কর্মকর্তা টেলিফোনে আরও বলেন, 'আকাশপথে পণ্য নেওয়া হলে কার্বন নিঃসরণ বেড়ে যাবে। এজন্য প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনই উত্তম।'

পণ্য পরিবহন খরচ ৩০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি ফ্রেইট অন বোর্ডের (এফওবি) মাধ্যমে তা পরিশোধ করছে। এই ব্যবস্থায় ক্রেতারা পণ্য পরিবহন খরচ বহন করেন।

'ইউরোপীয় ক্রেতারা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পণ্য পাঠাচ্ছেন' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে সরবরাহকারীদের পণ্য পরিবহন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদনের নির্দেশনা দিয়েছি। লোহিত সাগর সংকট শুরুর পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কোনো চালান উড়োজাহাজে আসেনি।'

ডাচ পোশাক ডিজাইনিং প্রতিষ্ঠান জি-স্টারের আঞ্চলিক অপারেশন ম্যানেজার শফিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লোহিত সাগরে সংঘাতের কারণে আমরা আকাশপথে পণ্য পরিবহনের দিকে যাইনি। তবে আমরা পণ্য পরিবহনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি।'

তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে তার প্রায় পাঁচ শতাংশ আকাশপথে পরিবহন করা হয়।

তবে পণ্য সরবরাহে সময় বেশি দরকার হওয়ায় তার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কার্যাদেশ কমিয়ে দিতে পারে বলেও জানান তিনি।

পোশাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিছু ক্রেতা দ্রুত পণ্য চাওয়ায় কার্যাদেশ নিয়ে নতুন করে আলোচনা করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ক্রেতারা ব্যয়বহুল এয়ার শিপমেন্ট চাচ্ছেন।'

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খরচ বাড়বে বলে ক্রেতারা এখনো পুরোদমে আকাশপথে পণ্য পরিবহন শুরু করেননি।'

কিছু ইউরোপীয় ক্রেতা লোহিত সাগর সংকট শুরু হওয়ার আগেও আকাশপথে পণ্য পরিবহন পছন্দ করতেন।

বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা পোশাকের মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম আকাশপথে পাঠানো হয়।'

স্বাভাবিক যুদ্ধ-কভারেজ প্রিমিয়াম শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ ও পুনঃবিমাকারীরা এটি শূন্য দশমিক ২২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের পুনঃবীমা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বিবেকানন্দ সাহা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণ বীমা করপোরেশনের প্রিমিয়াম বৃদ্ধির বিষয়টি বাংলাদেশে তাদের গ্রাহক-বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানানো হয়েছে।'

গত ১৭ জানুয়ারি মার্শ ম্যাকলেনানের বিমা ব্রোকারেজ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সামুদ্রিক, কার্গো ও লজিস্টিকসের প্রধান মার্কাস বেকার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র এক নিবন্ধে বলেছেন, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-ঝুঁকির হার ডিসেম্বরের প্রথম দিকের শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশ থেকে বেড়ে শূন্য দশমিক সাত শতাংশে হয়েছে।

অর্থাৎ ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি কন্টেইনারের জন্য জাহাজ বিমা করতে এখন খরচ প্রতি যাত্রায় ১০ হাজার ডলার থেকে বেড়ে সাত লাখ ডলার হয়েছে।

স্থানীয় পোশাক সরবরাহকারীরা বলছেন, ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় যে বাড়তি খরচ হবে তা শেষ পর্যন্ত পরোক্ষভাবে স্থানীয় সরবরাহকারীদের ওপর চাপানো হবে।

এক বিশ্লেষক বলেছেন যে বিমার খরচ বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যাওয়া। এটি শেষ পর্যন্ত খুচরা পর্যায়ে ক্রেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। কেননা, এর কারণে পণ্যের দাম বাড়বে।

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

8h ago