মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত মানুষ, বাজেটে সামান্য স্বস্তি

উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য দুই বছর ধরে ভুগছে দেশের জনগণ। ক্রয়ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ায় বিশেষ করে কষ্টে আছে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী।
এই শ্রেণির জনগণের কথা মাথায় রাখা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে। সেখানে খাদ্য ভর্তুকি প্রায় ২০ শতাংশ বাড়িয়ে নয় হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে।
বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দশমিক নয় শতাংশ বাড়িয়ে ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা করা হয়েছে।
সামনের অর্থবছরে ৫৫ লাখ নিম্ন আয়ের পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে, চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৫০ লাখ। এই পরিবারগুলো ১৫ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি পর্যন্ত চাল পাবে। প্রতিটি পরিবার এই সহায়তা পাবে ছয় মাস পর্যন্ত—চলতি অর্থবছরে যা ছিল পাঁচ মাস।
তবে ইউএনডিপির হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অফিস ও দারিদ্র্যবিষয়ক শাখার সাবেক পরিচালক সেলিম জাহানের মতে, এই পদক্ষেপগুলো 'যথেষ্ট না'।
আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
'সরকারের পুরো বাজেট পরিকল্পনাই দাঁড়িয়ে আছে এই পূর্বধারণার ওপর যে তারা মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনতে পারবে। আমার মনে হয় না এটা বাস্তবসম্মত লক্ষ্য,' বলেন সেলিম জাহান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের নিচে নামেনি। গত ৪০ বছরে কখনোই এতো দীর্ঘ সময় ধরে এই হারে মূল্যস্ফীতি বিরাজ করেনি।
প্রকৃত মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের বেশি থাকলে প্রস্তাবিত খাদ্য ভর্তুকি কার্যক্রমগুলো নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য প্রত্যাশিত স্বস্তি বয়ে আনতে পারবে না বলে মনে করেন সেলিম।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২২ দশমিক নয় শতাংশে দাঁড়াতে পারে। ২০২২ সালে যা ছিল ১৮ দশমিক সাত শতাংশ। চরম দারিদ্র্যের হারও সাত দশমিক সাত শতাংশ থেকে বেড়ে নয় দশমিক তিন শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যার মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকেই।
এই তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর দেশের আরও ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারে।
সেলিম জাহানের মতে, 'মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপগুলো অপর্যাপ্ত, অস্থায়ী এবং মোটেই সমন্বিত না। এসব পদক্ষেপের বেশিরভাগই চাহিদা-পৃষ্ঠভিত্তিক। আর প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাগুলো উপেক্ষা করে এসব পদক্ষেপকে কেবল নীতিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।'
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় থাকা বাধাগুলো দূর করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে তাতে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দেয় বলে মন্তব্য করেন সেলিম।
'এছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবও বিনিয়োগে পড়ে। বিনিয়োগই আবার উৎপাদনের অন্যতম চালিকাশক্তি,' বলেন এই সাবেক ইউএনডিপি কর্মকর্তা।
বাজারমুখী বিনিময় হার কমে গেলে টাকার মান কমে যাবে, আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। যে কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
'সরকারের উচিত নিজেকে দুটি প্রশ্ন করা: এক, বিশ্ববাজারে বহু পণ্যের দাম কমে এলেও দেশের বাজারে তা কমছে না কেন? দুই, যদি শ্রীলঙ্কা মাত্র দুই বছরে মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশ থেকে ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারছে না?'
খাদ্য ভর্তুকি এক ধরনের সহানুভূতিভিত্তিক দান, যা তাৎক্ষণিক স্বস্তি দিতে পারে।
'স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে মানুষের জন্য টেকসই স্বস্তি নিশ্চিত করতে চাইলে ভর্তুকির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে,' যোগ করেন সেলিম।
Comments