চট্টগ্রামের কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়: গৌরব আর ঐতিহ্যের ১০৫ বছর
বাইরে থেকে প্রথম দেখায় মনে হবে, গ্রামের আর দশটা স্কুলের মতই ছায়াঘেরা একটি টিনশেড স্কুল এটি। তবে ভেতর পা রাখতেই দেখা মিলবে এর আভিজাত্য ও বিশেষ নির্মাণশৈলীর। নাকে এসে ধরা দেবে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক বাংলাদেশের ঘ্রাণ।
কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার আকুবদণ্ডী গ্রামের কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়। ১০৫ বছর আগে যাত্রা শুরু এই স্কুলের। এই স্কুলের ভবনটি দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রাচীন মৃৎভবন।
১৯১৭ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় স্থানীয়দের শিক্ষার প্রসারে যাত্রা শুরু হয় এই স্কুলের। ২০৩ ফুট লম্বা এবং ৪৫ ফুট চওড়া মাটির তৈরি স্কুলটি ব্রিটিশ আমলের স্থানীয় স্থাপত্যের জানান দেয়।
পাশেই আছে সুবিশাল ও ঐতিহাসিক 'পার্বতী চরণ দীঘি', যা স্কুলের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ৮ কক্ষবিশিষ্ট স্কুলটি ৭৫টি পিলারের ওপর নির্মিত। এর ছাদ কাঠ ও টিনের।
২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর স্কুলটিকে দেশেরঅন্যতম প্রাচীন মৃৎভবন ঘোষণা দিয়ে এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে সরকার।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে এ অঞ্চলের কয়েকজন শিক্ষাবিদ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে বোয়ালখালীর প্রাণকৃষ্ণ চৌধুরীর দান করা ৯ একর জমিতে বাঁশের বেড়া ও মাটি দিয়ে একটি অস্থায়ী ঘর বানানো হয়। প্রথমে স্কুলটিতে শুধু সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণির কার্যক্রম ছিল। পরে অনান্য শ্রেণির কার্যক্রম শুরু করা হয়।
সেই সময় ভারতবর্ষ জুড়ে চলা স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বাঁশের বেড়া, মাটি, ছন এবং অন্যান্য স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে স্কুল ভবনটি তৈরি করা হয়। স্কুলের নির্মাণকাজ শেষ করতে ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২ বছর সময় লেগেছিল।
বিধুভূষণ চৌধুরী ছিলেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক। তিনি ছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের 'অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের' একজন প্রভাবশালী শিক্ষক নেতা। তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯২১ এবং ১৯২৫ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন।
স্কুল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুসারে, স্কুলটি প্রথম ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে এবং ১৯৪৬ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে স্থায়ী স্বীকৃতি পায়।
এই মাটির স্কুলের একটি কক্ষেই ১৯৪৩ সালের বাংলার কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য 'ক্ষুধার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম—চট্টগ্রাম: বীর চট্টগ্রাম' কবিতাটি লিখেছিলেন। বর্তমানে ওই কক্ষটি শিক্ষার্থীদের কাছে 'সুকান্ত কক্ষ' নামে পরিচিত।
স্কুল কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, এই স্কুলেই রয়েছে দেশের স্কুল পর্যায়ে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। শিক্ষার্থীদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে স্কুলের মূল কাঠামোর বাইরেও আরো বেশ কয়েকটি পাকা স্থাপনা বানানো হয়েছে।
তবে শতবর্ষী এই স্কুলটির সংস্কার প্রয়োজন। গত রোববার স্কুলটিতে গিয়ে দেখা যায়, মাটির দেয়ালগুলোর বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। এ ছাড়া, ছাদে টিনের চালার নিচে দেওয়া কাঠ ও বাঁশের চাটাইগুলো বিভিন্ন স্থানে খুলে পড়েছে। দেয়ালের কয়েকটি জায়গায় গর্ত তৈরি হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানায়, বর্ষাকালে ছাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে থেকে বৃষ্টির পানি পড়ে।
স্কুলের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. আমির হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গেজেট জারির পর মহামারির আগে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মীরা স্কুলের একটি কক্ষের দেয়ালের কিছু অংশ সংস্কার করেন। করোনা মহামারি চলাকালে সংস্কার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আমরা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে একাধিক চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।'
স্কুলটির বর্তমান প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ বড়ুয়া বলেন, 'কাঠামোর প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য বজায় রাখার জন্য এর নিয়মিত সংস্কার প্রয়োজন। স্কুলের তহবিল ব্যবহার করে আমরা একাধিকবার তা করেছি।'
যোগাযোগ করা হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিচালক একেএম সাইফুর রহমান পলিন বলেন, 'আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্কার কাজ অগ্রাধিকারভিত্তিতে পরিচালনা করি। বর্তমানে স্কুলে কোনো সংস্কার চলছে না। তবে আগামী ৫ বছরের পরিকল্পনার আওতায় আমরা এটি শুরু করতে পারব বলে আশা করছি।'
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে ঐতিহাসিক স্কুলটিকে জাতীয়করণ করেছে। বর্তমানে প্রায় ৯০৬ জন শিক্ষার্থী পড়ছে স্কুলটিতে। শিক্ষক আছেন ১৩ জন। তবে তারা এখনো সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় আসেননি।
এই স্কুলে প্রাচীন একটি গ্রন্থাগার আছে, যেখানে ব্রিটিশ আমলেরও নানা বই সংরক্ষিত আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন এই স্কুলের ৪ ছাত্র ও ২ শিক্ষক। নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে স্কুলটি যথাযথভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয়রা।
Comments