সংবাদ-টকশো প্রচার নিষিদ্ধ করে ওটিটি নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়া হাইকোর্টে
সংবাদ ও টক-শো সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে ওটিটি নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করে সিদ্ধান্তের জন্য হাইকোর্টে পাঠিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।
সোমবার খসড়াটি জমা দেওয়া হয়েছে বলে হাইকোর্ট সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, ওটিটি এমন এক ধরনের মিডিয়া পরিষেবা যা দর্শকদের কাছে ইন্টারনেট বা সমজাতীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান নাটক, সিনেমা, ডকুমেন্টারি, ফিকশন, নন-ফিকশন, খেলাধুলা, ডকুফিকশন, ইনফোটেইনমেন্ট, বিজ্ঞাপন ও ভিডিও অন ডিমান্ড, বাংলাদেশের ভেতরে সম্প্রচারের অথবা প্রদর্শনের জন্য অনুমোদিত টেলিভিশন চ্যানেলের অপরিবর্তিত কনটেন্ট (সংবাদ ও টকশো ছাড়া) সরাসরি সম্প্রচার বা ধারণকৃত কনটেন্ট সেবা প্রচার করবে।
অর্থাৎ খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ করা সংজ্ঞা অনুযায়ী ওটিটি প্ল্যাটফরমে শুধু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি সম্প্রচার করা যেতে পারে, তবে সংবাদ ও টক-শো কোনোভাবেই প্রচার করা যাবে না।
খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী, রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও অখণ্ডতার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী তথা প্রচলিত আইনের পরিপন্থী, দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী, সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্টকারী তথ্য উপকরণকে নিষিদ্ধ কনটেন্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা এবং বিজ্ঞাপন প্রদর্শন নীতিমালা ২০২১ শিরোনামের ওটিটি নীতিমালার এ চূড়ান্ত খসড়া হাইকোর্টের আগের নির্দেশনা অনুযায়ী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় সোমবার পেশ করেন।
একই সময়ে একটি রিট আবেদনের শুনানির সময় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই-রকিবের মাধ্যমে 'ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নীতিমালা ২০২১' এর একটি পৃথক খসড়া হাইকোর্টে জমা দেয়।
বিচারপতি জেবিএম হাসান এবং বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ খসড়াগুলো গ্রহণ করেন।
হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশ দেওয়ার জন্য আগামী ১৯ অক্টোবর তারিখ নির্ধারণ করেন এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসিকে আদালতের সামনে নীতিমালার অগ্রগতি সম্পর্কে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
রিট আবেদনকারী এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তথ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংজ্ঞায়িত বিষয়বস্তু ছাড়া সংবাদ বা টক-শো প্রচার নিষিদ্ধ করতে ওটিটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে, যা সংসদে আইন হিসেবে পাস হতে পারে।'
তিনি বলেন, 'এ নীতিমালা সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে কি না, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার যোগ্যতা আমার নেই।'
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় নীতিমালার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জমা দেওয়া খসড়া নীতিমালায় বলা হয়, ইচ্ছাকৃতভাবে বা বিদ্বেষপূর্ণ কারণে কোনো কনটেন্টের মাধ্যমে জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা করা যাবে না।
শিশুদের নিয়ে যৌনাচার উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কোনো কনটেন্ট এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করে, রাষ্ট্র ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কনটেন্ট তৈরি বা সম্প্রচার করা যাবে না।
রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন বা উপযুক্ত আদালতের নিষিদ্ধ করা কোনো কনটেন্ট এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর এমন কনটেন্ট সম্প্রচার করা যাবে না।
যদি কোনো নিবন্ধিত প্ল্যাটফর্ম নীতিমালা লঙ্ঘন করে কোনো নিষিদ্ধ কনটেন্ট সম্প্রচার করে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ ওই ওটিটি প্ল্যাটফরমকে সেসব কনটেন্ট সরাতে নির্দেশ দেবে এবং ওটিটি কর্তৃপক্ষ সেগুলো সরাতে বাধ্য থাকবে।
এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিবন্ধন কর্তৃপক্ষকে সব ধরনের সহায়তা দেবে।
প্রতিটি অনলাইন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম প্রোভাইডার (কিউরেটেড এবং আনকিউরেটেড) প্রতিষ্ঠানকে অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
কোনো অভিযোগ পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে ওটিটি প্রতিষ্ঠান অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে, অভিযোগকারী নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারবেন।
খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ৮ ধারার বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
এতে আরও বলা হয়, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম প্রোভাইডার অর্থ একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফরম যা গ্রাহক বা ব্যবহারকারী বা তৃতীয় পক্ষকে কনটেন্ট সেবা গ্রহণ বা আপলোড করার অনুমতি বা সুবিধা দেয়।
এই নীতিমালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে খসড়ায় বলা হয়, সৃজনশীলতা লালন, সৃজনশীল শিল্পকর্ম তৈরিতে সহযোগিতা এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
এ দিকে বিটিআরসির খসড়া নীতিমালায় 'অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বা অবনতি ঘটায়' বা 'আপত্তিকর, মিথ্যা বা হুমকিস্বরূপ এবং ব্যক্তির জন্য অবমাননাকর' এমন কোনো বিষয়বস্তুকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এতেও জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকাকে অবমাননাকর বা 'সরকারের গোপনীয়তার জন্য হুমকিস্বরূপ' এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বক্তব্য, বাংলাদেশের ঐক্য, অখণ্ডতা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব এবং বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন বিষয়বস্তুকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ নীতিমালা অনুযায়ী, সব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমের জন্য দেশে অভিযোগ দেওয়ার জন্য একজন আবাসিক কমপ্লেইন অফিসার, সুবিধাদি নিশ্চিত করতে একজন কমপ্লায়েন্স অফিসার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিটিআরসির সঙ্গে সমন্বয় করতে একজন এজেন্ট থাকতে হবে।
Comments