‘সত্য আড়াল করে মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করতেই সোশ্যাল মিডিয়া-ওটিটি নীতিমালা’
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রস্তাবিত ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম রেগুলেশনের খসড়া 'নীতিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যকে আড়াল করে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এর মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠ রোধ করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা।'
আজ শনিবার বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, '২০১৩ সালে আইসিটি অ্যাক্ট সংশোধন করে ৫৭ ধারা যোগ করে এবং ২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের জনগণ এবং মিডিয়ার বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত করার পর এখন অবশিষ্ট সামান্য যে বাক স্বাধীনতাটুকু রয়েছে সেটুকু পুরোপুরি কেড়ে নেওয়ার জন্য সরকারের ২টি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২টি নতুন নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
বিটিআরসি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সামাজিক যোগযোগমাধ্যম এবং ওটিটি খসড়া নীতিমালার উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'নিবর্তনমূলক এই ২টি নীতিমালা কার্যকর করা হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি অনলাইনভিত্তিক মিডিয়াগুলোর মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে। পাশাপাশি অনলাইন এনক্রিপশনকে অকার্যকর করে অনলাইন নিরাপত্তাকে দুর্বল করে তুলবে। এর ফলে মানবাধিকারের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পরবে এবং সাংবাদিক, বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পরবে।'
বিটিআরসির খসড়া রেগুলেশনের বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগ সরকারের সমস্যা হচ্ছে, তারা রাষ্ট্র এবং সরকারকে এক করে দেখে। সেই কারণে সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলেও তারা সেটাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রচার বলে মনে করে। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাসহ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় মামলা দিয়ে হয়রানির মধ্যে ফেলে।'
তিনি আরও বলেন, 'স্মরণ করা যেতে পারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখার কারণে সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছিল। অতি সম্প্রতি আমরা দেখতে পেলাম, সেই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাইকে ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের দায়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।'
'মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যে পরিমাণ ইতিহাস বিকৃত করেছে সে বিষয়ে কথা না বলার জন্য তারা এই নীতিমালা ব্যবহার করবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ঘোষণা প্রচার করা হয়েছে, দেশের মানুষ সেই ঘোষণা শুনেছে, বিদেশি পত্র-পত্রিকায় সেই ঘোষণার কথা প্রকাশ হয়েছে। তারপরও তারা কোর্টের আদেশ ও সংবিধান সংশোধন করে স্বাধীনতার ঘোষকের নাম বদলে দিয়েছে। ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে তারা আদালত এবং সংবিধানের মাধ্যমে বদলে দেয়, তারপর সেই বিকৃত ইতিহাস রক্ষার জন্য এই বিবর্তনমূলক নীতিমালার পেছনে আশ্রয় নিতে চাচ্ছে।'
'দুর্নীতি, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা এবং দলীয় করণের কারণে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার বইতে লিখেছেন। ১৯৭২-৭৫ এর সময়ে রক্ষী বাহিনীসহ তৎকালীন আওয়ামী লীগের লাল বাহিনী টাইপের বাহিনীর হাতে ৩০ হাজারে বেশি বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে এক দলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই সকল বিষয়ে আলোচনা করলেও সেটা এই নীতিমালায় আওতায় অপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে।'
'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার কারণে গত বছর সাংবাদিক রোজিনাকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছিল। সেই সময় সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যে রোজিনা সরকারে গোপন নথি চুরি করছিল। সরকার পরিচালনায় থাকা আমলা-মন্ত্রীরা যদি দুর্নীতি করেন তাহলে সেগুলো মিডিয়া বা সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে যেন প্রচার করা না হয় তার রক্ষা কবচ হিসেবে বিটিআরসির এই নীতিমালা ব্যবহার করা যাবে।'
'রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় রাষ্ট্রের। কিন্তু আমরা দেখতে পাই দু-একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আওয়ামী লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের। এমন কোনো রাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই দেশের জনগণের মাঝে এবং মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। বিটিআরসির প্রস্তাবিত নীতিমালার মাধ্যমে জনগণের সেই প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।'
জায়মা রহমানের নামে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ অপপ্রচার করেছেন এবং এ বিষয়ে আদালত মামলা নেননি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের কোনো আওয়ামী লীগ নেতার দুর্নীতির বিরুদ্ধেও যদি কোনো কিছু লেখা হয় তাহলেও বিটিআরসির নীতিমালার মাধ্যমে সেই লেখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।'
'সোজা কথায় বলা যায়, এই নিবর্তনমূলক নীতিমালাটি করা হয়েছে শুধু মাত্র আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, অপশাসন, তাদের ভোট ডাকাতি, তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুমও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রচার ঠেকানোর জন্য। এমনকি এই বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে প্রচার করা হলে সেটা যেন বাংলাদেশের জনগণ দেখতে না পায় সেজন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওটিটি কন্টেন্টভিত্তিক পরিসেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।'
'বিটিআরসি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই ২ নীতিমালা শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গেই সাংঘর্ষিক নয়, বরং জাতিসংঘ ঘোষিত ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসেরও পরিপন্থী।'
কোনো নিবর্তনমূলক আইন দিয়েই তথ্যের প্রচার বন্ধ করা যায় না উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, 'মানুষ সত্য জানার আগ্রহ থেকেই সত্য তথ্য খুঁজে বের করে নেয়।'
'মুক্ত গণমাধ্যমে সূচকে বাংলাদেশের স্থান এমনিতেই তলানিতে। এমনকি মিয়ানমারের চেয়েও পিছিয়ে। সরকারের এই ২ নীতিমালা মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও পিছিয়ে উত্তর কোরিয়ার কাতারে নিয়ে দাঁড় করাবে। আমরা বাংলাদেশের এমন অসম্মান দেখতে চাই না।'
বিটিআরসি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই ২ নীতিমালাসহ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে আরও শক্তিশালী করতেই এই ২ নীতিমালা করা হচ্ছে।'
Comments