পেঁয়াজ সংরক্ষণে এখনো কৃষকের ভরসা বাঁশের মাচা
পেঁয়াজের রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাবনার সুজানগর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের কৃষক মো. কামরুজ্জামান ও তার ভাই এ বছর প্রায় ৮২ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছে। ফলনও পেয়েছে বেশ ভালো। তারা ঘরে তুলেছিলেন প্রায় ৫ হাজার মণ পেঁয়াজ।
পেঁয়াজ কাটার পর ৫০০ থেকে ৬০০ মণ পেঁয়াজ বিক্রি করেন তারা। আরও প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ মণ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়।
এই ২ ভাই ঘরে সংরক্ষণ করেছেন প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মণ পেঁয়াজ। আশা ছিল আগামী কার্তিক মাস পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজ বিক্রি করবেন তারা।
তবে, প্রতি মাসে তাদের প্রায় ১০ কেজির বেশি পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত উৎপাদন খরচও তুলতে পারবেন না বলে আশঙ্কা কাদের।
কামরুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক মণ পেঁয়াজ উৎপাদন করতে প্রায় এক হাজার ১৫০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। সংরক্ষণ, বাছাইকরণ, বস্তাজাত করা এবং পরিবহনে প্রতি মণে খরচ আরও প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। কিন্তু বাজারে এখন এক হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।'
দামের এই অবস্থার পাশাপাশি পেঁয়াজ পচে যাওয়ায় বড় লোকসানের আশঙ্কায় রয়েছেন তিনি।
তার মতো একই অবস্থা ওই গ্রামের কৃষক মো. চাঁদ আলির। এ বছর প্রায় ১ হাজার মণ পেঁয়াজ ঘরে তুলেছেন তিনি। মৌসুমের শুরুতে দাম ভালো না পাওয়ায় পুরো পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে এখন আরও বিপাকে পড়েছে চাঁদ আলি।
ইতোমধ্যে তার প্রায় ৩০০ মণ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। অতিরিক্ত গরমে পেঁয়াজ দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
চাঁদ আলি বলেন, 'আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় প্রাচীন পদ্ধতির বাঁশের মাচাই আমাদের একমাত্র ভরসা।'
সরেজমিনে দুর্গাপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রতিটি চাষির ঘরেই রয়েছে পেঁয়াজ সংরক্ষণের প্রাচীন পদ্ধতির বাঁশের মাচার ঘর।
সুজানগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রাফিউল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের সর্ববৃহৎ পেঁয়াজ উৎপাদনকারী অঞ্চল সুজানগরে রয়েছে প্রায় ৭ হাজারের বেশি প্রাচীন পদ্ধতির পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার।'
২৫ থেকে ৪০ হাত লম্বা প্রায় ১০ ফুট উঁচু ঘরের ৭ ফুট উপরে বাঁশের তৈরি বিশেষ মাচা পদ্ধতি করে বাতাস প্রবেশের রাস্তা রেখে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন কৃষক।
প্রতিটি খাঁচার ২ ফুট পর্যন্ত পুরু করে মাচায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন কৃষক। এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা গেলেও কমপক্ষে ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানান কৃষক।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ যে কয়েকটি বিষয় দ্রুত গতিতে এগিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম কৃষিক্ষেত্র। গত কয়েক দশকে কৃষির বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হওয়ায় বেড়েছে উৎপাদন ও উচ্চ ফলনশীল ফসলের আবাদ।
খাদ্য চাহিদা মেটাতে যখন উৎপাদন বাড়াতে ব্যস্ত কৃষি বিভাগ, তখন বাম্পার পেঁয়াজের উৎপাদন করেও শুধুমাত্র সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশের বেশি উৎপাদিত পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে।
এই ঘাটতি পূরণে প্রতি বছর সরকারকে ঠিক নষ্টের সম পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার বাড়ির পরিচালক (ক্রপস উইং) মো. জাহিদুল আমিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর দেশে ২ দশমিক ৫৩ লাখ হেক্টর জমিতে ৩৩ দশমিক ৫৬ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। এ বছর দেশে ২ দশমিক ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩৬ দশমিক ৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে।'
তবে প্রতি বছরের মতোই উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্যে প্রায় ৮ থেকে ৯ লাখ মেট্রিক টন কৃষকের ঘরেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
আর এ ঘাটতি পূরণ করতে প্রতি বছর ৭ থেকে ৮ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে।
আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত বাণিজ্যিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় বাম্পার উৎপাদন করেও প্রতি বছর চাহিদার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে উন্নত করে পেঁয়াজের ঘাটতি কমানো গেলে আমদানি নির্ভরতা কমবে বলে যোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পেঁয়াজ উৎপাদনের পর ১০ শতাংশ লোকসান একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে পেঁয়াজ সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা এখনো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।'
মসলা গবেষণা কেন্দ্র একটি বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে। এটি নির্মাণ করা হলে পেঁয়াজ সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা ত্বরান্বিত হবে বলে জানান তিনি।
কৃষকের ঘরে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য প্রাচীন পদ্ধতিকে আরেকটু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করলে লোকসান কমানো সম্ভব বলে যোগ করেন তিনি।
ড. শৈলেন্দ্রনাথ বলেন, 'কৃষক টিনের চালের নিচে একটি সিলিং দিয়ে পেঁয়াজের ঘরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এ ছাড়া, ৬ থেকে ৯ ইঞ্চির বেশি পুরু না করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে পর্যাপ্ত বাতাস পাবে এবং এতে পেঁয়াজের পচন আরও কমানো যাবে।'
কৃষকের অভিযোগ, সরকারি উদ্যোগ না থাকায় বছরের পর বছর তারা নিজেদের উদ্যোগে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শেখা বাঁশের মাচায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছে।
প্রথাগত এই ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক করতে প্রয়োজন সরকারি সহায়তা।
সুজানগর উপজেলার পেঁয়াজ চাষি লিটন মণ্ডল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন বাণিজ্যিকভাবে পেঁয়াজের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ সংরক্ষণের মতো পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার স্থান ও অর্থের সংস্থান কৃষকের নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা প্রত্যেকেই নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় আলাদা ঘর তুলে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছি। বাজারে কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়ার আশায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলেও এ বছর মৌসুমের শুরু থেকেই পেঁয়াজ আমদানি শুরু হওয়ায় কৃষক কাঙ্ক্ষিত দাম পায়নি। তাই ঘরেই নষ্ট হচ্ছে পেঁয়াজ।'
পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের পচন রোধ করে কৃষকের স্বার্থে আধুনিক সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার দাবি জানান তিনি।
Comments