দিনাজপুরে লিচু পাড়া শুরু, বিরূপ আবহাওয়ায় ফলন কমার আশঙ্কা

দিনাজপুরের বাজারে আসতে শুরু করেছে লিচু। তবে বাজার জমে উঠতে আরও এক থেকে দেড় সপ্তাহ সময় লাগবে। ছবি: কংকন কর্মকার/ স্টার

দিনাজপুরের বাজারে আসতে শুরু করেছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রসালো মৌসুমি ফল লিচু। তবে বাজার জমে উঠতে আরও এক থেকে দেড় সপ্তাহ সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

লিচু দিনাজপুর জেলার একটি ব্র্যান্ডিং শস্য। প্রতি বছর দিনাজপুর জেলা শহরের কালিতলা এলাকায় বসে লিচুর বাজার। তবে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে লিচুর বাজারটি স্থানান্তর করে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের গোর-এ শহীদ বড় মাঠে। এবারও সেখানেই বসবে লিচুর বাজার।

স্বাদে, গন্ধে দিনাজপুরের লিচুই দেশে সেরা দাবি এখানকার চাষিদের। ছবি: স্টার

মাঠের একাংশে গত ২ বছর ধরে দেশের বৃহত্তম এই লিচুর বাজার বসে। মৌসুমি এই ফলের উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে এই বাজার চলে প্রায় এক থেকে দেড় মাস। এখান থেকেই মূলত দিনাজপুরের উৎপাদিত লিচু চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এ ছাড়া, অনেক বাগান থেকেও সরাসরি ট্রাকে করে লিচু নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে, মোটামুটিভাবে দেশের প্রায় সব জেলাতেই লিচু উৎপাদন হয়। তবে অনুকূল আবহাওয়া ও মাটির উর্বরতার কারণে উত্তরের জেলাগুলোতে বিশেষ করে দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ যশোর, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরায় লিচু উৎপাদন হয়। তবে দিনাজপুরের চাষিদের দাবি, এখানকার লিচুই স্বাদে সেরা।

দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায় লিচু বাগানে গাছে গাছে ঝুলছে থোকা থোকা লিচু। ছবি: স্টার

লিচুর মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের দিনাজপুরের লিচুর প্রতি থাকে অন্যরকম এক টান। জেলার বিস্তৃত লিচু বাগানগুলোতে গাছে গাছে পাকা লিচু দেখা ও গাছ থেকে সংগ্রহ করে খাওয়াও আরেক ধরনের মজা। এজন্য প্রতি বছর বিভিন্ন জেলা থেকে এসময় দিনাজপুরে ঘুরতে আসেন অনেকেই।

রংপুর বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের ৮ জেলায় প্রায় ৯ হাজার ১৯৭ হেক্টর জমিতে এ বছর লিচু উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে প্রায় ৪৭ হাজার টন।

এরমধ্যে শুধু দিনাজপুরেই জমির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৫০০ হেক্টর। জেলার ১৩ উপজেলাতেই কম-বেশি লিচু উৎপাদন হয়। তবে দিনাজপুর সদর, বিরল, কাহারোল ও চিরিরন্দর উপজেলার লিচুর উৎপাদন বেশি হয়।

দিনাজপুরে বাগানের গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে লিচু। ছবি: স্টার

বোম্বাই, মাদ্রাজি, বেদানা, কাঁঠালি ও চায়না-১, ২ ও ৩ জাতের লিচু এখানে আবাদ করা হয়। শাঁস বেশি এবং সুস্বাদু হওয়ায় বেদানা ও চায়না–৩ জাতের লিচুর দাম বেশি থাকে প্রতি বছরই। এ জাতের লিচু বাজারে প্রতি ১০০ পিস বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায়।

জেলায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয় বোম্বাই লিচু। আর কম হয় বেদানা লিচু। মূলত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে লিচু গাছে ফুল আসার পর থেকে কৃষক বা বাগান মালিকদের ব্যস্ততা বাড়ে। চলে বাগানের গাছ পরিচর্যা। ফুল থেকে গাছে মুকুল আসা পর্যন্ত সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুকুল আসা পরবর্তী সময় আবহাওয়া ভালো না হলে উৎপাদনের ওপর প্রভাব পড়ে বলে জানান চাষিরা।

দিনাজপুর সদরের লিচু চাষি জিয়াউর রহমান ও বিরল উপজেলার রেজাউল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এ বছর লিচুর উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কম হবে। মূলত এ বছর মুকুল আসার সময় তাপমাত্রা ওঠা-নামা করা, অসময়ে কুয়াশা ও বিভিন্ন সময় শিলাবৃষ্টি সামগ্রিকভাবে লিচুর উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে।

পাশাপাশি গত এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি ও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় লিচুতে পোকা ধরার আশঙ্কা করছেন চাষিরা।

তারপরও করোনার কারণে গত ২ বছর লিচুর ভালো দাম না পেলেও এবার ভালো দাম পাওয়ার আশা করছেন চাষিরা। সে আশাতেই বাগানে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।

গত কয়েকদিন দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ লিচু বাগানের গাছে গাছে ঝুলছে থোকা থোকা লিচু। কিছু বাগানে পাকতেও শুরু করেছে লিচু। তবে পরিপূর্ণভাবে পাকতে আরও বেশ কিছু দিন সময় লাগবে।

বেশ কয়েকটি বাগানে এ বছর লিচুর আকারও ছোট হয়েছে বলে জানান চাষিরা।

বাগান মালিক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিপক্ব রসালো লিচু বাজারে আসতে সময় লাগবে আরও অন্তত ২ সপ্তাহ। এখন শেষ মুহূর্তে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগান মালিকরা। গাছের লিচুকে হৃষ্টপুষ্ট করতে হরমোনসহ বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করছেন তারা।

শেষ মুহূর্তে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগান মালিকরা। ছবি: স্টার

জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে বাগান আছে প্রায় ৪ হাজার। ইতোমধ্যেই মাদ্রাজি জাতের লিচুর গায়ে রং আসতে শুরু করেছে। আর বোম্বাই, বেদানা, চায়না-৩ ও কাঁঠালি লিচু সবুজ রঙেই গাছে ঝুলছে। মূলত মাদ্রাজি জাতের লিচু বরাবরের মতো আগে বাজারে আসে। পরবর্তীতে অন্যান্য জাতগুলো একে একে বাজার দখল করে। বোম্বাই জাতের লিচু একটু দেরিতে বাজারে আসে।

বিরল উপজেলার মাধববাটী গ্রামের লিচু বাগান মালিক আনারুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণত মাদ্রাজি জাতের লিচু আগে পাকে। আর শেষে পাকে বোম্বাই, বেদানা ও চায়না-৩সহ অন্যান্য লিচু।'

তিনি আরও বলেন, 'মাদ্রাজি লিচু পরিপক্ব হতে আরও অন্তত ১ সপ্তাহ লাগবে। আর পরিপক্ব বোম্বাই, বেদানা, চায়না-৩ বাজারে আসতে সময় লাগবে আরও ২ সপ্তাহ।'

একই উপজেলার পুরিয়া গ্রামের লিচু চাষি মতিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এসব লিচু পরিপক্ব হয়ে উঠবে। তবে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটসহ কিছু কিছু এলাকায় অপরিপক্ব লিচু বাজারে উঠতে শুরু করেছে।'

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কিছু বাগান মালিক অধিক লাভের আশায় অপরিপক্ব লিচু বাজারে এনে বিক্রি করছেন।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) খালেদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দিনাজপুর জেলায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে। এই বাগানগুলোতে লিচু উৎপাদন হয় প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন।'

তবে আবহাওয়া কিছুটা বিরূপ হওয়ায় এবার উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়বে বলে জানান তিনি।

এখন বাজারে মাদ্রাজি জাতের প্রতি ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা দরে।

সব মিলিয়ে দিনাজপুরের লিচু স্থানীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান হচ্ছে প্রায় কয়েক হাজার মানুষের।

এ বছর লিচু থেকে প্রায় ৫০০-৫৫০ কোটি টাকার ব্যবসার আশা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

 

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

9h ago