‘এখন প্রয়োজন মাথার ওপর নিরাপদ ছাদ’

ভাঙা ঘরে নাতিকে নিয়ে বসে আছেন গুলমালা বিবি। ছবি: স্টার

রাস্তার পাশের একটি গ্যারেজের সামনে বসে বন্যার পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়া ধান থেকে ভালোগুলো বাছার চেষ্টা করছিলেন নাসিমা বেগম (৭০)।

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার বাশকালা গ্রামের এই গ্যারেজের পাশে থাকা তার ঘর বন্যায় ভেসে গেছে। ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে তার পরিবারের সারা বছরের খাবার হিসেবে রাখা ধান। বন্যার পানি বাড়তে থাকার সময় বাড়ি ছেড়ে সামান্য দূরে একটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা।

'আমার ঘরে সারাবছর খাওয়ার মতো ধান থাকতেও দুই দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। আর পানি নামার পরে ফিরে দেখলাম ধানগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। সঙ্গে বাড়িও ভেঙে গেছে', বলেন তিনি।

গত ১৬ জুন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও ভারতের মেঘালয়ে অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যার পানির তোড়ে ছাতক থেকে দোয়ারাবাজার উপজেলায় যাওয়ার নবনির্মিত একটি সড়কের পাশের এই গ্রামের অন্তত ২৫টি বাড়ি একেবারে ভেঙে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও অনেক। বন্যায় একেবারে ভেঙে যাওয়া এই সড়কের ওপরে নির্মিত কালভার্টের ওপরে বসবাস করছেন ৪ পরিবার। বাকিরা ভাঙা ঘর কোনোমতে দাঁড় করিয়ে তাতে থাকছেন।

এই গ্রামের বাসিন্দা ৬ সন্তানের মা জমিরুন বেগম বলেন, 'পানির ঢল যখন নামছে, কোনোমতে শিশুদের নিয়ে নিরাপদে বের হতে পেরেছি। এখন ঘরবাড়ি হারিয়ে কালভার্টের ওপরে থাকছি। নিরাপত্তার অভাবে বড় মেয়েকে আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।'

এই গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যার দুই দিন পর থেকে ত্রাণ পাচ্ছেন তারা। এখন পর্যন্ত একবার সরকারি ত্রাণ ও কয়েকবার বেসরকারি ত্রাণ পেয়েছেন। যে কারণে খেয়ে বাঁচার মতো পর্যাপ্ত খাবার তাদের কাছে আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে খাবারের চেয়ে বেশি দরকার ঘর।

বাশকালা গ্রামের রাজিয়া বেগম বলেন, 'যে পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা পেয়েছি, এখন আপাতত খাবারের কোনো সংকট নেই। এখন প্রয়োজন মাথার ওপর নিরাপদ ছাদ।'

ছাতক উপজেলার সুফিনগর-জাওয়াকারা গ্রাম ছাতক যাওয়ার সড়কের পাশেই। এই গ্রামের সরকারি খাস জমিতে বাড়ি বানিয়ে থাকেন ১০টি হতদরিদ্র পরিবার, যাদের সবার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ফারুকের ভাঙা ঘর। ছবি: স্টার

এই গ্রামের প্রতিবন্ধী ফারুক আহমেদের কাছে এই বন্যার ধাক্কা সামলানো অনেকটা কঠিন। ভিক্ষা করে জীবনযাপন করা ফারুকের পক্ষে কারো সহায়তা ছাড়া কোনোদিনই নতুন ঘর বানানো বা সংস্কার করা সম্ভব না।

'আমি বড় অসহায় হয়ে পড়েছি। পরিবার নিয়ে ছাপড়া বানিয়ে থাকছি। কেউ সাহায্য না করলে কোনোদিন বাড়ি বানাতে পারব না', বলেন তিনি।

ফারুক আহমেদ যখন তার ভেঙে পড়া ঘর দেখাচ্ছিলেন, তখন পাশেই বানানো ছাপড়াতে তার মা গুলমালা বিবি ছোট নাতিকে নিয়ে বসেছিলেন।

তাদের মতোই সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাজারো মানুষ এখন গৃহহীন, সহায়-সম্বলহীন। কেউ কেউ সড়কের ওপরে, কেউবা গ্রামের মধ্যেই ছাপড়া ঘর বানিয়ে কোনোমতে আশ্রয় নিয়েছেন। আর লক্ষাধিক মানুষ এখনো বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন, যাদের বেশিরভাগেরই ফিরে যাওয়ার মতো কোনো ঘর নেই।

জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, সিলেট বিভাগে ৬৩ লাখ মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছেন, যার মধ্যে ৬০ লাখের বেশি কেবলমাত্র সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলাতে।

তথ্যমতে, দুই জেলার ৯৯ হাজার ৭৯১টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই দরিদ্র ও অতিদরিদ্র পরিবারের, যারা নিজেদের সঞ্চয় থেকে নতুন বাড়ি নির্মাণ বা সংস্কারে সমর্থ নন।

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, 'যাদের বাড়িঘর ভেঙে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সরকারিভাবে সম্পূর্ণ খরচ বহন করে তা পুনর্নির্মাণ করে দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে হাওরাঞ্চলের অনেক বাড়ির ভিটার মাটিও ধুয়ে গেছে; সেসব পরিবারপ্রতি অন্তত ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া উচিত।'

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ইতোমধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১০ হাজার পরিবারের বাড়িঘর সংস্কারে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

দুই জেলার প্রতিটিতে তালিকা করে ৫ হাজার করে পরিবারকে এই সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এই টাকা বাড়িঘর সংস্কার ছাড়াও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসামগ্রী কেনার জন্যেও ব্যয় করা যাবে।

প্রথম ধাপে এ অর্থ সাহায্যের জন্য বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পেশাজীবী পরিবারকে প্রাধান্য দিয়ে তালিকা প্রস্তুত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।

Comments

The Daily Star  | English

5,500 new govt jobs likely

The government is likely to approve the creation of over 5,500 new posts across various ministries and agencies today, following proposals submitted by at least 10 ministries and divisions, officials said.

8h ago