মহুয়া হাজংয়ের মামলা নেওয়া না নেওয়া ও ‘প্রভাবশালী’ প্রসঙ্গ

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় বিচারপতির ছেলে সাইফ হাসানের গাড়ির ধাক্কায় এক পা হারান ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মহুয়া হাজংয়ের বাবা মনোরঞ্জন হাজং। ঘটনার ১৪ দিন পর অভিযুক্তের পরিচয় জানা সত্ত্বেও ‘অজ্ঞাতনামা’ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েছে পুলিশ।
অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন, পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস (বাঁ দিক থেকে)। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় বিচারপতির ছেলে সাইফ হাসানের গাড়ির ধাক্কায় এক পা হারান ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মহুয়া হাজংয়ের বাবা মনোরঞ্জন হাজং। ঘটনার ১৪ দিন পর অভিযুক্তের পরিচয় জানা সত্ত্বেও 'অজ্ঞাতনামা' ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েছে পুলিশ।

এর আগে মহুয়া হাজংয়ের পরিবারের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেন অভিযুক্ত সাইফ হাসান। শুরুতে সাইফ হাসানের পরিচয় গণমাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়নি।

মামলার অগ্রগতি এবং এ বিষয়ে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরে আজম মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তদন্ত চলছে। তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে।'

এসব সার্বিক বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীনঅধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদার সঙ্গে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বলেন, 'বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে এখন গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে নিশ্চুপ দেখা যায়। তার কারণ হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও আরও নানা ধরনের হয়রানিমূলক নিশ্চুপিকরণ পদ্ধতি তো আছেই। কিন্তু তারচেয়েও বড় কারণ বলে আমি মনে করি সংবাদমাধ্যমের ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। এই ক্ষমতা সংশ্লিষ্টতা বা সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য সংবাদমাধ্যমের যে "ওয়াচডগের" ভূমিকা পালন করার কথা তার বদলে তারা "ল্যাপডগ" হয়ে উঠেছে।'

তিনি বলেন, 'দেশে বহুদিন ধরেই যে নীরবতার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠেছে, তার কারণ বিচারহীনতা ও ভুক্তভোগীর হয়রানি। এই ঘটনায় শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ, অর্থাৎ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ২টি অঙ্গ জড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের আচরণ অস্বচ্ছ। ঘটনাস্থল থেকে আটক করার পরেও অভিযুক্তকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, মামলা গ্রহণ করা হয়নি। ঘটনার ফুটেজ থাকার পরেও ভুক্তভোগীই অপরাধ করেছেন মর্মে অভিযোগ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের যে অঙ্গগুলোর একজন সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা, সুবিচার প্রদানের কথা, সেই অংশগুলো তা করছে না। সুতরাং এখানে কোনো সুশাসন বিরাজ করছে না বলা যায়। এরকম অবস্থায় নাগরিকরা প্রতিনিয়ত শঙ্কার মধ্যে বাস করেন।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রভাবশালী বলতে এখন বোঝানো হয়, যারা যা খুশি তাই করতে পারেন এবং যাদের আইন স্পর্শ করতে পারে না। শুধু তাই নয়, যারা আইনকে নিজেদের মতো পরিচালনা করেন তারাই প্রভাবশালী। একটি রাষ্ট্রে প্রভাবশালী অংশ হওয়ার কথা জনগণের। কিন্তু আমরা সেই প্রভাবশালীদের কথা বলছি যারা জনগণকে জিম্মি করে রেখেছেন এবং এজন্য যাদের জবাবদিহিতা নেই।'

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, 'আমাদের গণমাধ্যম ক্ষমতাবানদের পক্ষে, বিত্তবানদের পক্ষে, যারা ঢাকায় বাস করেন তাদের পক্ষে এবং পুরুষের পক্ষে। যারা নারী, যারা প্রান্তিক, যারা গরিব তাদেরকে সবসময় গণমাধ্যমে প্রান্তিকভাবে দেখা হয়। যেহেতু ক্ষমতার সম্পর্ক রয়ে গেছে তাই তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। বিচারপতির ছেলে দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত এটা পরিষ্কার। গণমাধ্যম চাইলে অভিযুক্ত উল্লেখ করেও তার পরিচয় লিখতে পারতো।  ক্ষমতার কারণেই এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। ক্ষমতাবানদের প্রতি মিডিয়ার পক্ষপাতের কারণেই তার নাম পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।'

তিনি বলেন, 'পরিচয় উল্লেখ না করার আরেকটা কারণ হতে পারে আদালতকে গণমাধ্যমের ভয়। মহুয়া হাজং একজন সার্জেন্ট না হয়ে যদি পুলিশেরই বা অন্য কোনো বাহিনীর বড় কর্মকর্তা হতেন বা বড় ব্যবসায়ী হতেন তাহলে অবশ্যই মামলা নেওয়া হতো এবং তাকে হয়রানি করা হতো না।'

ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, 'মহুয়া হাজংয়ের মামলা নিতে দেরি করা এবং নাম পরিচয় জানা সত্ত্বেও মামলার এজাহারে বিচারপতির ছেলের নাম উল্লেখ না করা সীমাহীন অবিচার। মনোরঞ্জন হাজং দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন, হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন, অথচ তার পক্ষে তেমন কেউ দাঁড়ায়নি। উল্টো তাদেরকে হেনস্তা করার জন্য আবার জিডি করা হয়েছে।'

'অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন বিচারপতির ছেলে, এলিট, ক্ষমতাবান। আমাদের প্রশাসন তাদের পক্ষেই কাজ করেন। এখানে ক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। যারা ঘটনা ঘটিয়েছেন তারা ক্ষমতার ওপরের স্তরে এবং ভুক্তভোগী প্রান্তিক স্তরে। এখান থেকে একটা শিক্ষার বিষয় হলো, পুলিশ দেশে নানান ধরনের অন্যায় করে, দুর্নীতি করে, অপকর্ম করে। এখন পুলিশের নিজের ওপর যখন বিষয়টি আসছে তখন পুলিশ কিন্তু নিজেদের বিচার চাইতে ভয় পাচ্ছে। পুলিশের সীমাহীন অবিচারের আরেকটি নমুনা হচ্ছে এই ঘটনাটি। পুলিশ যেমন অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়ে, এবার তারা সেই গর্তে নিজেরাই পড়েছে। অধিক ক্ষমতাবানদের কাছে তারাও অসহায় হয়ে গেছে,' তিনি যোগ করেন।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'ঘটনাস্থল থেকে অভিযুক্তকে গাড়িসহ থানায় নেওয়ার পরেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ১৪ দিন পর অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করে মামলা নেওয়া হলো। এর ২ দিন আগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ভুক্তভোগী পরিবারের বিরুদ্ধে জিডি করেছেন। সেই জিডিতেই তো অভিযুক্তের বিস্তারিত তথ্য ছিল। তথ্য থাকার পরেও ১৪ দিন পর মামলা হলো অজ্ঞাতনামা হিসেবে। আমি হিসাবে মেলাতে পারলাম না।'

তিনি বলেন, 'সেই অভিযুক্তের নামে মামলা না নেওয়া সুস্পষ্ট ক্রিমিনাল অপরাধ এবং পেশাগত দায়িত্ব লঙ্ঘন। বনানী থানার ওসির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। এর জন্য যথাযথ ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব। দেশের নাগরিক হিসেবে মহুয়া হাংজ সুবিচার পাননি। এতে তার মৌলিক অধিকার খর্ব হয়েছে।'

সুপ্রিমকোর্টের এই আইনজীবী আরও বলেন, 'আমরা মুখে বলি, বিচার বিভাগ স্বাধীন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এগুলো আসলে কেতাবি কথা। আইনও নিজের নিয়মে চলে না, আর বিচার ব্যবস্থাও নিজের মতো করে চলতে পারছে না। যারা উচ্চ পদে আছেন বা অনেক বিত্তবান তারা নানাভাবে নিজের অপরাধগুলো জায়েজ করার জন্য প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। এই প্রভাবগুলো যারা বিস্তার করেন তাদের প্রভাবশালী বলা হয়। এটি অসম্মানজনক একটি শব্দ। কারণ ভালো কাজে তাদের কোনো প্রভাব দেখানোর নজির নেই। খারাপ কাজের জন্যই এই তথাকথিত প্রভাবশালী মহল প্রভাব খাটায়। অন্যায়ের সুবিধা নেওয়ার জন্য, অন্যকে সুবিধা বঞ্চিত করার জন্য তারা প্রভাব খাটান।'

'কেউ খারাপ কাজে প্রভাব বিস্তার করছে, কিন্তু তার নাম বলা যায় না। বললে হেনস্তার শিকার হতে হয়। যিনি অন্যায় করবেন তিনি নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা পাবেন, নানা বলয়ের মধ্যে থাকবেন—এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ক্ষমতার অব্যবহারের কারণেই এগুলো হচ্ছে। এটা আমাদের আইনের একটা দুর্বলতা,' তিনি যোগ করেন।

মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন 'পুলিশের উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গেই মামলা নেওয়া। সেই ঘটনায় যা হয়েছে তা আসলেই দুর্ভাগ্যজনক। এমন ঘটনায় অবশ্যই মামলা নিতে হবে। মামলা না নেওয়া দুর্বলতা। এটাকে সিস্টেম বলে না। সিস্টেম বলে, যখন কোনো অপরাধের ঘটনা আসে তখন পুলিশের কাজ হলো মামলা নেওয়া। পরে তদন্ত করে দেখতে হবে ঘটনা সত্য কি না। তবে সাধারণত কোনো ধর্তব্য কেস আসলে পুলিশের কাজ হলো সেটি রেকর্ড করা। তারপর তদন্ত করে দেখা।'

পুলিশের সাবেক এই আইজিপি বলেন, 'অভিযোগকারী যখন নাম ধরে বলছে তখন অভিযুক্তের নাম রাখা উচিত, এটা বাঞ্ছনীয়। যে নাম রাখেনি সেটি তার দোষ। মামলার এজাহার কোনো বাইবেল না। বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে হবে। আইনে প্রভাবশালী বলে কোনো কথা নেই। আইনের চোখে সবাই সমান। অভিযুক্ত যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে অবশ্যই অভিযোগ নিতে হবে। অবশ্যই তদন্ত করতে হবে। প্রভাবশালী শব্দের অর্থ আমি বুঝি না। কোথাও বলা নেই যে প্রভাবশালী হলে মামলা নেওয়া যাবে না বা তাকে ছাড় দেওয়া হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'মহুয়া হাজংয়ের ঘটনায় আইনের কিছুটা ব্যত্যয় হয়েছে। এতদিন কেন মামলা নিলো না তা জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। ধর্তব্য অপরাধে মামলা করতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই মামলা নিতে হবে। কেন নেয়নি তার কৈফিয়ত তলব করা যেতে পারে। উপরস্থ অফিসার বা কোর্ট এই কৈফিয়ত তলব করতে পারেন।'

Comments

The Daily Star  | English

Five crisis-hit banks secure BB guarantee for liquidity

Five crisis-hit banks have obtained a Bangladesh Bank (BB) guarantee to avail liquidity support from the inter-bank money market, according to central bank officials.

1h ago