বিমাখাতের দুর্গতির কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন ও দুর্বল নিয়ন্ত্রক সংস্থা

১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে নিবন্ধিত বিমা প্রতিষ্ঠানের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি অনুমোদন পেয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।

তবে আস্থাহীনতার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকগুলোই গ্রাহক আকৃষ্ট করতে পারছে না।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্য অনুসারে, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে ৭২ বিমা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি—৬০টি—প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়েছে হাসিনা সরকারের আমলে।

২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কোনো বিমা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়নি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এত বেশি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, যা দেশের চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত।

এই খাতে পেশাদারিত্ব ও জনসাধারণের আস্থার অভাব আছে। কেননা, অনেক প্রতিষ্ঠানকে কেবল রাজনৈতিক পছন্দের ভিত্তিতে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।

বিমা দাবি নিষ্পত্তির সংখ্যা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় কম হওয়ায় এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমবর্ধমান তারল্য সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা এখন একত্রীকরণ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে শক্তিশালী করার মতো কঠোর উদ্যোগের আহ্বান জানাচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. মঈন উদ্দিনের মতে, আওয়ামী লীগের টানা চার মেয়াদে আর্থিক সুবিধা প্রত্যাশী নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এসব গোষ্ঠী প্রায়ই রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে অর্থ উপার্জনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়া রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।'

তিনি মনে করেন, যারা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদন নেন ও যারা তা অনুমোদন দেন, তারা উভয়ই আর্থিকভাবে লাভবান হন।

তিনি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী না করে এতগুলো বিমা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়ার পেছনে সরকারের উদ্দেশ্যের কঠোর সমালোচনা করেন।

'রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে এ খাতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়েনি,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

নিবন্ধনের সংখ্যা

প্রতিবেশী ভারতে ৫৭, পাকিস্তানে ৪০ ও শ্রীলঙ্কায় ২৮টির বিপরীতে বাংলাদেশে মোট বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮২টি।

বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেটলাইফ একমাত্র বিদেশি। এ ছাড়া লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (এলআইসি) 'এলআইসি বাংলাদেশ' নামে এ দেশে ব্যবসা করছে।

আইডিআরএর তথ্য অনুসারে, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনটি জীবন বিমা ও আটটি সাধারণ বিমা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়েছিল।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সর্বোচ্চ ১৩টি জীবন বিমা ও ২৭টি সাধারণ বিমা প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা বিএনপি-জামায়াত জোট একটি সাধারণ বিমা প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছিল।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাসিনা সরকার ১৮ জীবন বিমা ও দুটি সাধারণ বিমা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে।

রাজনৈতিক সংযোগ

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সংখ্যক ইন্সুরেন্স কোম্পানি থাকার কারণে এই খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে এই খাতে এক ধরনের অস্থিরতা লেগেই আছে।

এ কারণেই অনেক কোম্পানিতে বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব কোম্পানিকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। তারপর যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালানোর যোগ্য, তারা কোম্পানির বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ কারণে অনেক কোম্পানি তাদের পেশাদারিত্ব ধরে রাখতে পারেনি।'

'বাংলাদেশে বিমাখাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ২০১৩ সালে। ওই সময়ে একই সঙ্গে ১৩টি জীবন বিমা কোম্পানিকে ব্যবসার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যে সময় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সে সময় বলা হয়েছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে,' বলেন তিনি।

'কিন্তু বর্তমানে যা পরিস্থিতি তাতে দেখা যাচ্ছে, কিছু কর্মসংস্থান হলেও এই খাতটিই পঙ্গু হয়ে গেছে।'

তার মতে আইডিআরএর উচিত, যে কোম্পানিগুলো দুর্বল হয়ে গেছে তাদের বোর্ড ও ম্যানেজমেন্টকে ডেকে চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়া। কারণ ওই কোম্পানিগুলোর গ্রাহকরা তাদের টাকা আর ফেরত পাবেন না।

অনেক বেশি বিমা প্রতিষ্ঠান

দেশের বিমা খাতে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক কর্মকর্তার মতে, বাজারে বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হলে তা অনৈতিক চর্চাকে উত্সাহিত করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, 'সবাই একই জায়গায় প্রতিযোগিতা করায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে এত প্রতিষ্ঠানের তদারকি করা কঠিন।'

তিনি আরও বলেন, 'একটি বিমা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক পদে থাকাকে মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অনেকে প্রতিষ্ঠান করলেও অনেক সময় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন।'

এই খাতে পেশাদারিত্বের অভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোকে বিমা-পণ্য চালুর অনুমতি দেয়।

সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস, ব্যাংকগুলো বিমার ওপর জনসাধারণের আস্থা ফেরাতে সহায়তা করতে পারে।

২০১৩ সালে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা জীবন বিমা সলভেন্সি মার্জিন রেগুলেশনের খসড়া প্রকাশ করে। তবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

সেই কর্মকর্তা মনে করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে এই বিধিমালা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন করা কঠিন।

তিনি বলেন, 'যদি এটি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে কিছু প্রতিষ্ঠান সম্ভবত দেউলিয়া হয়ে যাবে বা একীভূতকরণের আগ্রহ দেখাবে।'

অপর বিমা বিশেষজ্ঞের মতে, অনেক বিমা প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক প্রয়োজনের তুলনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পেয়েছে। তিনি মনে করেন, 'এত প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল না।'

বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় আর্থিক অসদাচরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তার ভাষ্য, 'বিমা প্রতিষ্ঠান অর্থপাচারের একটি পথ। এসব প্রতিষ্ঠানকে লুটপাটে ব্যবহার করা হয়। এ কারণেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দুর্বল করা হয়েছে।'

বহুজাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ২২ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও জীবন বিমা বিশেষজ্ঞ আসিফুর রহমান মনে করেন, 'দেশের অর্থনীতি ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ছয় থেকে ১০টি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত।'

তিনি বলেন, 'সংখ্যাটা বেশি হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের প্রয়োজন নয় এমন বিমা পণ্যও বিভিন্নভাবে মোটিভেট করে বিক্রয় করে। এর ফলে তামাদি পলিসির সংখ্যাও বাড়ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'অনেকে গ্রাহকের দায় পরিশোধের কথা বিবেচনা না করে বড় অংকের প্রিমিয়াম অর্জনের দ্রুত উপায় হিসেবে এই খাতকে দেখেন। একটি কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য মাত্র ১৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি এই খাতের সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।'

সলভেন্সি মার্জিন নীতি বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরে তিনি বিমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে শক্তিশালী করার বিষয়ে পূর্ববর্তী সরকারের অবহেলার সমালোচনা করেন।

দাবি নিষ্পত্তিতে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি

বাংলাদেশের জিডিপিতে বিমাখাতের অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ, যেখানে ভারতে চার দশমিক দুই শতাংশ ও পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৯১ শতাংশ।

আইডিআরএর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় এক কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার মানুষ বিমা করেছেন।

বিপুল সংখ্যক বিমা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও দেশের গড় বিমা দাবি নিষ্পত্তির অনুপাত বৈশ্বিক মান ৯৭-৯৮ শতাংশ থেকে অনেক পিছিয়ে।

প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে গড় বিমা দাবি নিষ্পত্তি অনুপাত ছিল প্রায় ৯৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

এর বিপরীতে ২০২৩ সালে দেশে বিমা নিষ্পত্তির হার ছিল ৬৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।

গত মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ বিমাকারীর সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার দাবি বিচারাধীন আছে। ২৯টি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে।

গত ১৪ বছরে বিমাকারীদের আর্থিক অবস্থার অবনতি, সচেতনতার অভাব ও এজেন্টরা বিমা-পণ্যের সুবিধা-অসুবিধাগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা না করায় ২৬ লাখেরও বেশি পলিসি বাতিল হয়েছে।

২০০৯ সালে মোট পলিসির সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি ১২ লাখ। ২০২৩ সালে তা কমে হয়েছে ৮৫ লাখ ৮০ হাজার।

একীভূতকরণই কি সমাধান?

গত ডিসেম্বরে ব্যাপক অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের কারণে আর্থিক সক্ষমতা হারানো বেশ কয়েকটি বিমা প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণের সুপারিশ করে আইডিআরএ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দাবি নিষ্পত্তিতে ব্যর্থতা বিমাখাতের প্রতি জনগণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ ইনসিওরেন্স, হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স ও প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নাম রয়েছে।

তবে এ বিষয়ে এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই।

২০০৭ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলামও মনে করেন, সরকার রুগ্ন কোম্পানিগুলোকে একীভূত করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।

তিনি বলেন, 'বিমাসহ দেশের আর্থিকখাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রতিষ্ঠান আছে। এটি অস্বাস্থ্যকর বাজার প্রতিযোগিতার দিকে পরিচালিত করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা খাতটিকে কার্যকরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। সরকারের এই দিকটাতে নজর দেওয়া উচিত।'

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at Korail slum

Five fire engines are rushing to the spot after the blaze originated around 4:15pm

9m ago