বন্যায় বিপর্যস্ত সুনামগঞ্জের ৪ ও সিলেটের ২ উপজেলা

ছবি: শেখ নাসির/স্টার

ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলা এবং সিলেটের সিলেট সিটি কপোরেশসনসহ কোম্পানিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

এক মাসের ব্যবধানে আবারও বন্যার কবলে পড়া এসব উপজেলার সবখানেই এখন বন্যার পানি থৈ থৈ করছে। সুরমা, পিয়াইন, চেলা, বটেরখাল, বোকা নদীসহ সব নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। প্রবল বেগে প্রবাহিত হচ্ছে পানি।

ছাতক

পাউবো সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জের ছাতক পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ছাতক শহরের রাস্তায় রিকশা, গাড়ির পরিবর্তে নৌকা চলাচল করছে। ইতোমধ্যে ছাতক উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ৪ লাখের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে ১৩টি ইউনিয়নের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

উত্তর খুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিল্লাল আহমদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ছাতক-সিলেট সড়কের ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ অংশটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেটসহ সারা দেশের সঙ্গে ছাতকের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শহরের অলিগলি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে নিমজ্জিত।

নোয়ারাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান পীর আব্দুল খালিক রাজা জানান, ছাতক-আমবাড়ি-সুনামগঞ্জ, ছাতক-দোয়ারা, ছাতক-জাউয়াবাজার, নোয়ারাই-বালিউরা, নরশিংপুর, চৌমুহনীবাজার, লক্ষ্মীবাউর সড়ক, কৈতক-হায়দরপুর, জালালপুর লামারসুলগঞ্জ, জাউয়া-বড়কাপন, মুক্তিরগাও, গোবিন্দগঞ্জ-লাকেশ্বর বাজার, বুরাইয়া, দোলার বাজার, কালারুকা, হাসনাবাদ, কান্দিগাও, হাদা, মাদ্রাসা বাজারসড়কসহ গ্রামীণ সব সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে উপজেলা সদরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ।

ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান সুফি আলম সুহেল জানান, ইউনিয়নে অনেক মৎস্য খামার, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে সব হাটবাজার। শত শত বসত ঘরে বন্যার পানি ঢুকেছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে অনেক মানুষ। ইউনিয়নের সব মানুষ পানিবন্দী অবস্থায়।

বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে এবং প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে ছাতক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামুনুর রহমান জানান, উপজেলার সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যা দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেয়া হয়েছে। বন্যার্তদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।

দোয়ারাবাজার

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে বন্যায় লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভাটিতে পানি বাড়ছেই। সুরমা, চেলা, মরাচেলা, চিলাই, চলতি, কালিউড়ি, খাসিয়ামারা, ধূমখালি, মৌলা ও ছাগলচোরাসহ বিভিন্ন নদীনালা, খালবিল ও হাওরের পানি বিপৎসীমার ওপরে  প্রবাহিত হচ্ছে।

সেইসঙ্গে উত্তাল ঢেউয়ে নদী তীরের দোকানপাট, স্থাপনা ও হাওর পাড়ের রাস্তাঘাটসহ অনেক কাঁচা বাড়িঘর ধসে যাচ্ছে। সবখানে বানের পানি থৈ থৈ করছে। গবাদিপশু ও পরিবার নিয়ে অর্ধাহারে ও অনাহারে দিন কাটছে অনেকের। গত ২ দিন ধরে জেলা ও উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে উপজেলার ৯ ইউনিয়নের।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাংশু কুমার সিংহ জানান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন দুর্গত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, জরুরি ওষুধপত্র, শুকনো খাবার ও চাল-ডাল বরাদ্দসহ জরুরি ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে।

বিশ্বম্ভরপুর

বিশ্বম্ভরপুরের বাসিন্দারা জানান, উপজেলা সদর, ফতেপুর ইউনিয়নে রায়পুর বাহাদুরপুর, গোপালপুর, চান্দারগাঁও, কাটাখালী, চাতলপাড়, ঘাগটিয়া, পলাশ ইউনিয়নের প্যারিনগর, পদ্মনগর, ধরেরপাড়, কৃষ্ণনগর, মুক্তিখলা, মল্লিকপুর, নতুনপাড়া, রংপুর, রনবিদ্যা, বাদাঘাট (দ:) ইউনিয়নের শ্রীধরপুর, সোনাপুর, বাঘমারা, দূর্গাপুর, ব্রজনাথপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, 'বন্যাকবলিত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। প্যারিনগর, ধরেরপাড় উপজেলা সদরসহ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন।' 

তাহিরপুর

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত ৩ দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই উপজেলায়।

উপজেলার সদর বাজার, সুলেমানপুর বাজার,বালিজুরি বাজার, পাতারগাও বাজার, কাউকান্দি বাজার, একতা বাজার, নতুন বাজার ও শ্রীপুর বাজার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে মানুষ। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।  

তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা জাবেদ মিয়া বলেন, 'এখানে বিদ্যুৎ নেই। যাদের বাড়িতে সোলার প্যানেল আছে সেগুলোও চার্জ হচ্ছে না। ফলে অন্ধকারে উপজেলাবাসী।'

ভাটি তাহিরপুর গ্রামের বাসিন্দা সাজ্জাদ সুমন বলেন, 'পাহাড়ি ঢলের পানিতে তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের আনোয়ারপুর-বালিজুরি-শক্তিয়ারখলা সড়ক পানির নিচে থাকায় তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কে সব ধরনের  যানবাহন চলাচল বন্ধ।'

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রায়হান কবির বলেন, 'উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এগুলো বিতরণ করবেন। সীমান্তের যাদুকাটা নদীর বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।'

সিলেট

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম গ্রামের করিম মাহমুদ বলেন, 'বন্যার পানি এত বেশি যে, এমন পানি আমরা কেবল ২০০৪ বা ১৯৯৮ সালের বন্যায় দেখেছি।'  

সিলেট নগরীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, 'মাত্র ২ সপ্তাহ আগে আমরা আকস্মিক বন্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। এখন আরেকটি আঘাত।'

সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, 'সদর উপজেলার সব এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। আমার বাড়িতেও পানি। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না।'

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবুর রহমান বলেন, 'পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী কোম্পানিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের অবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বন্যায় আটকে পড়া মানুষকে সাহায্য করার জন্য সেনাবাহিনী আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। আমরা মানুষকে উদ্ধার করার এবং তাদের জন্য ত্রাণ বাড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Dengue death toll crosses 500-mark

7 die, 629 hospitalised till this morning

1h ago