দীর্ঘ ছুটি শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্বে বিরূপ প্রভাব ফেলছে

করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ আছে। স্কুল-কলেজের চলমান ছুটি আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটি শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক (চাইল্ড প্রটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গর্ভন্যান্স) আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ ও দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অধীন চন্দ্র সরকার। ছবি: সংগৃহীত

করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ আছে। স্কুল-কলেজের চলমান ছুটি আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটি শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি শিক্ষার্থীদের আসক্তি, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, সাইবার বুলিং এমনকি যৌন হয়রানির ঘটনাও বাড়ছে বলে মনে করছেন তারা।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশে ১৭ মাসেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর কী ধরনের সামাজিক ও মানসিক প্রভাব পড়ছে, তা জানতে সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক (চাইল্ড প্রটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গর্ভন্যান্স) আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ, অভিভাবক সাবিনা ইয়াসমীন ও দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অধীন চন্দ্র সরকারের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়।

সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, '১৭ মাসের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুরা বেড়ে ওঠার জন্য বাহ্যিক পরিবেশ পাচ্ছে না। তাদের পৃথিবীটা অনেক ছোটো হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে না পারায় শিশুরা কারও সঙ্গে মিশতে পারছে না, খেলাধুলা করতে পারছে না। এটি তাদের বেড়ে ওঠাকে প্রভাবিত করছে এবং তাদেরকে এক ধরনের অন্তর্মুখী মানুষ হিসেবে তৈরি করছে। তাদের অন্যান্য সুকুমার বৃত্তির চর্চায়ও প্রভাব বিস্তার করছে।' 

তিনি বলেন, 'গ্রামের শিশুরা তেমনভাবে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে শহর ও গ্রামের শিশুদের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হচ্ছে।'

আবদুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘসময় বন্ধ থাকায় শিশুদের সুরক্ষা ঝুঁকি বেড়েছে। বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বেড়েছে। তাছাড়া ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে মেয়ে শিশুদের যৌন হয়রানি বেড়েছে এবং তারা নানাভাবে প্রতারণা ও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে।'

ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, 'একজন শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যেসব উপকরণ প্রয়োজন তা পূরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সকালে ঘুম থেকে ওঠা, নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে যাওয়া, বাড়ির কাজ করা, পড়াশোনা করা, গানবাজনা করা, বিশেষ বিশেষ দিবস পালন করা সম্পর্কে জানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সফরে যাওয়াসহ নানা বিষয়ে ব্যাঘাত ঘটছে। অনেকেই একটি ছোটো ঘরে আবদ্ধ থাকছে। এতে করে তাদের চিন্তার বিকাশে বা সামাজিকীকরণে প্রভাব বিস্তার করছে। আগে তারা বিভিন্ন বিষয়ে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতো। এখন এগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।'

'অতিরিক্ত ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদ বাড়বে, তারা কোনো কিছুতে উৎসাহ পাবে না। তাদের মধ্যে ডিজিটাল নির্ভরতা বাড়বে। ফলে পরিবার, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা কমবে। বিভিন্ন সংগঠনে নৈতিকতা, মূল্যবোধ শেখানো হয়। ডিভাইসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তাদের এই বিভিন্ন সাংগঠনিক দক্ষতা কমবে', যোগ করেন তিনি।

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ বলেন, 'দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে না পারায় শিক্ষার্থীদের মনের ওপর চাপ বাড়ছে, সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসে কিছু শিক্ষার্থী উপকৃত হলেও শিশুদের যে সামাজিক বিকাশ তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঘরে থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে আচরণজনিত সমস্যা হচ্ছে, ঘুমের সময় পরিবর্তন হচ্ছে। বাবা-মা মানসিকভাবে চাপ অনুভব করছেন এবং সেই চাপ শিশুদের মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে। এই সময়ে শিশুদের অনেক বেশি গুণগত সময় দিতে হবে। শিশুরা যাতে ডিভাইস বা অনলাইনের মধ্যে আটকে না থাকে, তাই তাদের জন্য ঘরোয়া খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে। বাবা-মা আলাদা করে তাদেরকে সময় দেবেন, বাসার ভেতর যতটা সম্ভব পারস্পরিক যোগাযোগ রাখতে হবে। অনলাইনে শুধু ক্লাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে গান, সংগীত, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করাতে হবে।'

সাভারের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার অভিভাবক সাবিনা ইয়াসমীন বলেন, 'যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল শিশুরা এক ধরনের নিয়মকানুনের মধ্যে থাকত। তাদের মধ্যে এক ধরনের শৃঙ্খলা ছিল। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, পড়ালেখা, খেলাধুলা একটা রুটিন অনুযায়ী হতো। এটি তাদের সময়ের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষা দিতো। কিন্তু মহামারিতে সেই ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে গেছে।'

তিনি বলেন, 'শিশুদের অনলাইনে ক্লাস করার জন্য ডিজিটাল ডিভাইস দিতে হচ্ছে। কিন্তু একপর্যায়ে দেখা যাচ্ছে তারা এই ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকায় বিভিন্ন ধরনের গেম খেলে অলস সময় পার করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে এই সমস্যাটি হতো না।'

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অধীন চন্দ্র সরকার বলেন, 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই খুলে দেওয়া হয়েছে। স্কুল-কলেজ দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর যে প্রভাব পড়বে তা পূরণ করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।'

তিনি বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে শিশুরা নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে নেই। তারা বিভিন্নভাবে অলস সময় কাটাচ্ছে, বাড়ির কিছু কাজ দিলে তাও ঠিক মতো করছে না। তাছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক যে নিয়মকানুন তারা তা প্রায় ভুলে যাচ্ছে। যা তাদের সামাজিক বিকাশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।'

'কিছু নিয়ম করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায়। যেমন: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি শ্রেণি সপ্তাহে একদিন স্কুলে আসবে, আরেকটি শ্রেণি আরেকদিন আসবে। এভাবে ধারাবাহিকভাবে পাঁচটি শ্রেণি পাঁচ দিন স্কুলে আসবে। এই নিয়ম করেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া যায়', যোগ করেন এই শিক্ষক।

Comments

The Daily Star  | English

Five crisis-hit banks secure BB guarantee for liquidity

Five crisis-hit banks have obtained a Bangladesh Bank (BB) guarantee to avail liquidity support from the inter-bank money market, according to central bank officials.

5h ago