ঝোল, ঘাটের থেকে ঘরের
যমুনা সেতু তৈরি হওয়ার আগে আমরা যখন নীলফামারীতে গ্রামের বাড়ি যেতাম, তখন আরিচা ফেরিঘাটে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হতো ফেরি পারাপারের অপেক্ষায়। সেটা ২ ঘণ্টা থেকে ৭ বা ৮ ঘণ্টাও লেগে যেতো। সেইসময় বাসে বসে থাকতে থাকতে যে খাবারটি সবচেয়ে বেশি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো, সেটা হচ্ছে ঘাটের পাশের ছাউনি দেওয়া হোটেলগুলোতে বড় বড় কড়াইয়ে সাজিয়ে রাখা লাল টকটকে মাছ, ডিম ও মুরগির ঝোল। পাশেই থাকতো আলু দিয়ে গরুর গোশতের ঝোল। মাছের মধ্যে ছিল ইলিশ, বোয়াল, কাতলা, মৃগেল, রুই, শোল, চিংড়ি, পাবদা ও ছোট মাছের ঝোল।
আরিচা ঘাটে ফেরি পার হয়ে উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার জন্য ঘাটে অপেক্ষা করার সময় কারো সাধ্য ছিল না এই তরকারিকে উপেক্ষা করার। আমার বাবার মূল লক্ষ্যই ছিল ওই হোটেলগুলোতে গিয়ে ঝোলে কবজি ডুবিয়ে ভাত খাওয়া ও আমাদের খাওয়ানো। এই পথের পাশের লাল ঝোল খাওয়া নিয়ে আম্মার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হলেও আব্বাকে নিরস্ত করা যেতো না।
ঝোলে কবজি ডুবানোর পর
যখন আব্বা এক বাটি মুরগি বা মাছের ঝোলের তরকারি প্রথম পাতে তুলে নিতেন তখন তার চেহারাটা দেখার মতো হতো। সরিষার তেলে শুকনো মরিচের গুঁড়া দিয়ে আগুনরঙা লাল ঝোল আব্বাসহ আমাদের মোহাবিষ্ট করে রাখতো। এক চামচ লাল ঝোল যখন গরম ধোয়া ওঠা গরম ভাতের ওপর ছড়িয়ে দিতো, মনে হতো সেটা যেন বেহেশতি ব্যাপার। লালচে হলুদ রঙের ঝোল দিয়ে ভাতটা মাখনো হলে পুরো ভাতটার রংই হয়ে যেতো হলদে।
গোপন রেসিপি
খাওয়া নিয়ে আব্বার ব্যাপক আগ্রহের কারণেই আব্বা হোটেল মালিকদের জিজ্ঞাসা করেছিল, ঝোলটা এত টকটকে লাল রঙের হয় কীভাবে? ওরা বলেছিল হলুদ ও কম ঝালের লাল মরিচ একসঙ্গে পেঁয়াজ দিয়ে বেটে এই কড়া রঙের ঝোল তৈরি করা হয়। আব্বার মুখে শুনে শুনে আম্মা বহুবার চেষ্টা করেন ঘাটের মতো মুরগির বা মাছের ঝোল রান্না করতে। কিন্তু পারেনি। আব্বা বলতেন, অমন হয়নি। লাল ঝোলের সেই পাগল করা গন্ধটাই নাকি নাকে এসে লাগছে না। পরে আম্মা বলেছিলেন, নিশ্চয়ই ঘাটের হোটেলের সেই রাঁধুনিরা রেসিপির বিশেষ কোনো মর্তবা আব্বাকে জানায়নি, গোপন করেছে।
ঝোল-ডাল ফ্রি যেখানে
কখনো যদি ঘাটে খাওয়া না হতো, তাহলে খেতে হতো স্টিমারে। ট্রেনে বা বাসে গেলে ঘাট থেকে বড় স্টিমারে বা ফেরিতে উঠতে হতো। ফেরির ছাদে ছিল ডাইনিং রুম। সেখানে মাছ বা মুরগি যাই খান, লাল ঝোল, ভাত ও ডাল ছিল ফ্রি। শুধু দাম দিতে হতো মুরগি বা মাছের টুকরার। সেই খালাসিদের রান্না করা ঝোলের স্বাদও ছিল অসাধারণ।
যারা স্টিমার বা লঞ্চে চেপে এখনো বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা বা বরগুনা যান, তারা জানেন, জাহাজের তরকারির লাল ঝোলের স্বাদ একদম অন্যরকম। অনেকেই দুষ্টুমি করে বলেন, এইসব রান্নায় নদীর পানি ঢেলে ঝোল বানানো হয় বলে সেই স্বাদ হয় জব্বর।
ঝোলের ইতিহাস
তরকারিতে ঝোল বা সুরুয়া বাংলাদেশ ও ভারতের রন্ধন শৈলীর একটা বিশেষ দিক। মশলা কষিয়ে পানি মেশানো হয় এতে। অনেকে বলেন, হালকা গরম পানি দিলে ঝোলটা বেশি মজার হয়। ঝোল নিরামিষ ও আমিষ ২ প্রকার তরকারিতেই দেওয়া হয়। মাছের ঝোলে সবজি ব্যবহার করার বেশি প্রচলন আছে বাংলাদেশে।
ঝোল শব্দটির উৎপত্তি 'ঝোর' থেকে এসেছে, সেটি আবার এসেছে 'ঝর' ধাতু থেকে। জলের মতো যা ঝরে পড়ে তাই নাম ঝোল। শোনা যায় বাংলাদেশ ও ভারতে এই ঝোল নাকি শুধু সাধারণ বাঙালিদের মধ্যেই প্রচলিত নয়, কৃত্তিবাস ওঝা রচিত রামায়ণ, চৈতন্যচরিতামৃত ও ধর্মমঙ্গলে ঝোলের উল্লেখ আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে সীতা ঝোল পরিবেশন করেছেন।
ইলিশের পাতলা ঝোলই সেরা
বিভিন্ন মাছের ঝোল বাঙালি পরিবারের সবচেয়ে প্রচলিত ও প্রিয় খাদ্য বলা যায়। তাজা ইলিশের পাতলা গরম ঝোল (শুধু হলুদ, কাচা মরিচ, লবণ ও পেঁয়াজে রান্না) দিয়ে আউশ চালের গরম ভাত খেতে অসাধারণ লাগে।
আবার এই ইলিশ মাছেই আলু, পটল, কাঁচা কলা, বড় শসা দিয়ে মাখা মাখা ঝোল করা যায়। সেই স্বাদও চমৎকার। শুধু মাছটা তাজা হলেই চলে। আবার অনেকে সরষে, কাঁচা মরিচ ও পোস্ত একসঙ্গে বেটে নিয়েও ইলিশের ঝোল রান্না করেন।
সব মাছের ঝোলই অসাধারণ
শুধু ইলিশ মাছ বলি কেন, গরম ভাতের সঙ্গে যেকোনো মাছের একটা টুকরা আর একটু ঝোল দিয়েই খাবার শেষ হয় নিমিষেই। যেকোনো মাছ বা মাছের টুকরা দিয়ে এভাবে রান্না করতে পারেন। কৈ, মাগুর, শিং, শোল মাছের সঙ্গে আলু, বেগুন, কপি ও টমেটোর ঝোল হতে পারে।
উত্তরাঞ্চলের মানুষ এসব মাছের ঝোলে নামানোর আগে একটু জিরার গুড়া ছড়িয়ে দেন। তখন স্বাদটা হয়ে যায় অন্যরকম। আবার কৈ মাছ ডালের বড়ি দিয়েও ঝোল করা হয়। অনেকে নিজের পছন্দ মতো মাছগুলোকে সাঁৎলে নেন, কেউবা মাছ না ভেজেই রান্না করেন।
রুই, বড় পুঁটি, কাতলা, আইড়, কালবাউশ, চিতল, বোয়াল ইত্যাদি মাছের ঝোল হতে পারে কালোজিরার ফোঁড়ন দিয়ে, মশলা কষিয়ে, পেঁয়াজ বেটে নিয়ে। মানুষ সাধারণত তাজা মাছের ঝোল খান আলু, পটল, বেগুন, টমেটো, কপি ও মটরশুঁটি দিয়ে। শুধু বেশি করে টমেটো দিয়েও হতে পারে মাছ-টমেটোর পাতলা লাল ঝোল। ওপরে ছড়িয়ে দিতে হবে কাঁচা মরিচের ফালি ও ধনিয়া পাতা। তবে ঝোল বলেই যে লাগাম ছাড়া পানি দিতে হবে, তা কিন্তু নয়। ঝোলের পানি দেওয়ার পর লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পানি আর তেল আলাদা হয়ে না যায়।
বিপদে পড়েও হতে পারে ঝোল
ধরেন বাসায় রুই বা কাতলা মাছের পরিমাণ কম আছে এবং সেই মাছ দিয়েই কয়েকজনের জন্য রান্না করতে হবে একটি তরকারি। মাছের টুকরোগুলো কষিয়ে ভেঙে নিন। এরপর বেশি করে টমেটো, সামান্য টমেটোর সস বা টমেটো পিউরি, সামান্য মসুরের ডাল দিয়ে একটু ভুনা করে নিন। জ্বাল কমিয়ে একটু বেশি পরিমাণে হালকা গরম পানি যোগ করুন। মাছের টুকরাগুলো দিয়ে দিন। অল্প আঁচে জ্বাল দিতে থাকুক। বাসায় পাকা দেশি বড়ই থাকলে তাতে কয়েকটা দিয়ে দিন। নামানোর আগে আদা কুচি বাগার দিয়ে নামিয়ে নিন। ব্যস হয়ে গেল মাছ, টমেটো, ডালের স্যুপ বা ঝোল।
আমার মাকে দেখেছি ছোট পুঁটি মাছ বা দেশি পুঁটি মাছ হালকা ভেজে নিয়ে পেঁয়াজ কলি দিয়ে পাতলা ঝোল রান্না করতে। নামানোর আগে এর মধ্যে সামান্য তেঁতুলের পানি দিতেন। এ ছাড়া ছোট তারা বাইন, ট্যাংরা, বাতাসি, কাজরি, পাবদা মাছও ঝিঙে, কচুর মুখি ও ধুন্ধুল দিয়ে মাখা মাখা ঝোল করা যায়।
অনেক মানুষ অনেকভাবে মাছের ঝোল তরকারি দিয়ে রান্না করেন এলাকাভেদে। বাড়িতে বেশি মানুষ থাকলে ঝোল করাটাই উত্তম। এতে বণ্টনে সুবিধা হয়। তবে চট্টগ্রামের মানুষ ঝোল কালচারের সঙ্গে, বিশেষ করে মাছ বা মাংসে সবজির মিশেল দিয়ে ঝোল রান্নাতে খুব একটা অভ্যস্ত নন। তাদের অধিকাংশ মানুষই কষা তরকারি পছন্দ করেন।
অন্যরকম স্মৃতিময় ঝোল
এতো গেল মাছ পর্ব। আমার কাছে ঝোলের আরেকটি স্মৃতিময় পর্ব হচ্ছে গ্রামের বাড়িতে যখন আমরা বেড়াতে যেতাম, দাদি তখন সিদ্ধ ডিম দিয়ে আলুর ডাল রান্না করতেন। বিরাট কাসার গামলায় টেবিলে দেওয়ার পর আমরা সবাই বড় চামচ ডুবিয়ে সেই আলুর ডালকে ঝোলের মতো নিতাম। এতো মজা যে, খেতে খেতে হয়রান হয়ে যেতাম। একটা ডিম, এক বাটি আলুর ডাল। বংশ পরম্পরায় আমরাও এখন এই খাবার রান্না করতে পারি। আমাদের বন্ধুদের কাছেও এই তরকারি খুব প্রিয়।
আলু সিদ্ধ করে ভেঙে নিতে হবে। এরপর তেলে পাঁচফোড়ন ও পেঁয়াজের বাগার দিয়ে আলুগুলো অল্প আঁচে একটু হলুদ দিয়ে ভেজে নিতে হবে। ডিম হালকা ভেজে সামান্য মশলায় ভুনে এর মধ্যে দিয়ে দিতে হবে। একটু কষিয়ে হালকা গরম পানি দিয়ে অল্প আঁচে ঢেকে রাখতে হবে। ৩-৪ বার বলক ওঠার পর জ্বাল বন্ধ করে দিতে হবে। চাইলে টমেটো কুচি, ধনিয়া পাতা দিতে পারেন নামানোর আগে। ধনিয়া পাতা না দিয়ে ভাজা জিরার গুড়াও দেওয়া যাবে।
রাঁধুনির হাতযশ
খাওয়া দাওয়ার স্বাদ আদতে নির্ভর করে বিভিন্ন অঞ্চলের রান্নার গুণাগুণ, রাঁধুনির হাতের গুণ আর মশলার উপর। যেমন তিতা করল্লারও যে ছোট মাছ দিয়ে ঝোল রান্না করা যায়, এটা না খেলে বোঝার উপায় নেই। করল্লা ধুয়ে নিয়ে পাতলা করে বা ডুমো সাইজ করে কেটে নিয়ে লবণ মাখিয়ে রস ঝড়িয়ে নিতে হবে। এরপর পরিষ্কার কাপড়ে মুছে তেলে হলুদ, লবণ দিয়ে হালকা ভেজে নিতে হবে। অনেকে একটু আলুও দেয়। এরপর যেকোনো ছোট মাছ বেশি করে পেঁয়াজ, রসুন কুচি ও হলুদ, কাঁচা মরিচ দিয়ে মেখে হাতের পানি দিয়ে চড়িয়ে দিন। মাখা মাখা হলে সেখানে ভাজা করল্লা দিয়ে ঝোল দিন অল্প বিস্তর। খুব মজা লাগবে খেতে। স্বাদে খানিকটা তিতা হলেও অন্যরকম লাগবে।
নিরামিষের ঝোলের কি স্বাদ কম
এই গরমে খেতে পারেন লাউয়ের ঝোল, পটলের ঝোল, ঝিঙের ঝোল আলু কুচি দিয়ে। এমনকি চাইলে ঢেঁড়স বা ভেন্ডির ঝোলও রান্না করতে পারেন। যারা খুব একটা আমিষ খেতে চান না, তারা এটা চেখে দেখতেই পারেন। লাউয়ের সঙ্গে সামান্য আলু ও টমেটো দিয়ে অল্প জিরা, ধনিয়া দিয়ে মেখে হালকা গরম পানি দিয়ে বসিয়ে দিন। হয়ে গেলে আদা কুচি, পেঁয়াজ দিয়ে বাগার দিন। লাউ শক্ত হলে প্রেশার কুকারেও দিতে পারেন।
পটলের সঙ্গে সামান্য মুগ ডাল বা বুটের ডাল ও আলু মিশিয়ে মজাদার ঝোল তরকারি হতে পারে। সঙ্গে সামান্য ছোট চিংড়ি। ধুন্ধুল, ঝিঙা সামান্য আলুসহ ঝোল হতে পারে। নামানোর আগে দিতে পারেন একটু কাঁচা আম কুচি।
উত্তরাঞ্চলে লাফা শাকের ঝোল হয়। তারা গরুর মাংসের ভুনা আর আলু ভর্তা দিয়ে লাফা শাকের ঝোল খায়। পালং শাক শিম, বেগুনসহ এভাবেই ঝোল করে রানতে পারেন, আবার মাগুর, শিং, শোল মাছ দিয়েও পালং শাকের ঝোল হতে পারে। ছোট মাছ দিয়েও পালং ও পুঁই শাকের ঝোল হয়।
ব্যক্তির পছন্দেই নির্ভর করবে ঝোলের চেহারা
কে ঝোল খাবেন, কে খাবেন না, কে পাতলা ঝোল খাবেন, কে ঘন বা কে মাছ ভেজে ঝোল রান্না করবেন, আর কে না ভেজেই কাঁচা মাছের ঝোল করবেন সেটা ব্যক্তির রুচির ওপর নির্ভর করে। যেমন ময়মনসিংহের কিছু এলাকা, নরসিংদী, ভৈরব, কুমিল্লা, সিলেট, মুন্সিগঞ্জ এলাকায় মাছের ঝোল হয় বেশ ঘন। অনেকেই মাছ হালকা ভেজে ঝোল করেন। কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ হাওড় এলাকা মাছে মাছময়। কিন্তু প্রায় সব মাছই বেশ কড়া করে ভেজেই ঝোল রান্না করেন। আবার সুনামগঞ্জের বিল বা হাওড়ের পাকা আইড় মাছের পাতলা ঝোল না খেলে জীবনটাই ব্যর্থ মনে হবে।
গ্রামের মেজবানিতে ঝোল
গ্রামের বাড়িতে বড় মেজবানি হলে গরু, খাসি বা মুরগির ঝোল হবেই। কারণ ঝোল এমন একটা ব্যাপার যে মানুষ গন্ধে গন্ধে শুধু ঝোল আলু দিয়ে ভাত মেখে এক থালা খেয়ে নিতে পারেন। অনেক মানুষ হলে ঝোল খাবারে বরকত আসে। অল্প খাবার অনেকে মিলে খেতে পারেন। যেমন ডিম কাঁচা পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ভেজে, টুকরো টুকরো করে কেটে সামান্য মশলায় ভুনে নিয়ে ঝোল ঝোল করে আলু কুচি দিয়ে রান্না করতে পারেন। অসাধারণ স্বাদ, খরচও কম।
আবার গোয়ালন্দ
আবার ফিরে আসি সেই ঘাটের মুরগি, মাছ, গরু ও ডিমের ঝোলের গল্পে। চাকরি সূত্রে নব্বই দশকের শুরুতে রাজবাড়ি যাওয়ার জন্য গোয়ালন্দ ঘাটে নামলাম। বহু দিন পর ঠিক সেইরকমই ছাউনি দেওয়া ছাপড়া হোটেল দেখলাম। সেই হোটেলগুলোতে আবার সেই মাছ, মুরগির লাল ঝোল। শুকনা মরিচের গুড়া দিয়ে মুরগির সেই লাল ঝোল। কবজি ডুবিয়ে আমরা ৪-৫ জন ভাত খেলাম। মুরগি আর মাছের সঙ্গে ঝোল ফ্রি।
রাজবাড়ি গিয়েও ডাকবাংলোতে বড় মোরগের যে ঝোল খেয়েছিলাম, সেটার স্বাদ আমার মুখে যেন এখনো লেগে আছে। রন্ধনকারীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী দিয়ে রেঁধেছে সে এমন ঝোল? বলেছিলেন, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ এবং লাল মরিচ একসঙ্গে পাটায় পিষে সরিষার তেল দিয়ে রেঁধেছেন। কিন্তু কই, সেই একই পদ্ধতিতে চেষ্টা করেও আমিতো পারিনি একইরকম রাঁধতে।
সৈয়দ মুজতবা আলী ঝোল নিয়ে কী লিখেছেন
মনে পড়ে গেল গোয়ালন্দ ঘাটের মুরগির ঝোলের কথা লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক ও ভ্রমণপ্রিয় খাদ্যরসিক মানুষ সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি তার একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 'বিক্রমপুরের মহিলারা পুরো বাংলার সেরা রাঁধুনি হিসাবে খ্যাতি পেয়েছিলেন সত্য কিন্তু তবুও তারা নাকি সাধারণ স্টিমারের অতি মামুলি মুরগির তরকারি কখনও রান্না করতে পারেননি। সে তথ্য জেনে আমার মুরগির ঝোল রাঁধতে না পারার দুঃখটাও ঘুচে গিয়েছিল।'
তিনি লিখেছিলেন, '৩০ বছর ধরে আমি গোয়ালন্দ স্টিমারে ভ্রমণ করেছি। সেখানে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে, আর আগের মতো নেই। কিন্তু পাল্টায়নি সেই খালাসিদের মুরগীর ঝোলের গন্ধ। রান্নার স্টাইল পাল্টেছে, ঝোলের ঘনত্ব, অতি রন্ধন, একটু মিষ্টি স্বাদ, কিন্তু ঘ্রাণটা রয়ে গেছে সেই আগের মতোই।'
আমরা বলতে পারবো না বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পদ খাবার পরেও কেন সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছে গোয়ালন্দ জাহাজের সেই মুরগীর ঝোল অনন্য সাধারণ হয়ে উঠেছিল।
শেষ করি নগর ঢাকার ঝোলের রহস্য দিয়ে
এখনকার ঢাকার মধ্যম মানের ও ছোট হোটেলগুলোতে যে মাছ, মুরগি, ডিম, গরু বা খাসির মাংসের ঝোল রান্না হয়, সেগুলোর সব স্বাদ কেন একই রকম হয়? আমার এক হোটেল ব্যবসায়ী বন্ধু বলেন, মাছ, মাংস, মুরগি, ডিম সব আলাদা করে রাখা হয় ভেজে বা কষিয়ে। ঝোল হয় একটাই। যে ক্রেতা যে তরকারির ঝোল চান, তাকে বাটিতে করে ওই কড়াইয়ের ঝোল দিয়েই বানিয়ে দেওয়া হয় মুরগি, মাছ বা গরুর গোশতের ঝোল। তাহলে বুঝুন অবস্থা।
Comments