খেলাপি ঋণ আবার ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়াল

এ এক মন খারাপ করা অগ্রগতি। খেলাপি ঋণ কমাতে ঋণের শ্রেণিবিন্যাস নীতি শিথিল করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তা সত্ত্বেও দেড় বছরেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) অর্থাৎ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা ৯ মাস আগের তুলনায় ১৪ শতাংশ ও গত ১ বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

গত বছরের মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার পরপরই ঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখনো ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। অর্থনীতির জন্য এটি একটি অশুভ লক্ষণ।

গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের কিস্তি স্থগিত করার নীতি ঘোষণা করে। অর্থনীতিতে মহামারির প্রভাব কেটে যেতে থাকায় যে সুবিধা শেষ হয়ে গেছে।

তবে ঋণগ্রহীতারা এখন তাদের মোট কিস্তির মাত্র ২৫ শতাংশ পরিশোধ করে খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচতে পারেন।

এদিকে জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ শতাংশ। তখন এর আকার ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা।

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, 'ব্যবসা কঠিন হয়ে ওঠায় এই মহামারি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু অনেক গ্রাহক মুনাফা করলেও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন।'

অভ্যাসগত খেলাপিদের সংখ্যা বাড়ছে জানিয়ে এই ব্যাংকার আরও বলেন, 'ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।'

তার ভাষ্য, ঋণ পরিশোধ না করা গ্রহীতারা মনে করেন যে, তারা আমানতকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করলেও কোনো শাস্তির মুখোমুখি হবেন না। তাই একবার যদি শিথিলতা প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত সহনশীল নীতির কারণ ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল।

এই নীতির আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলিকে বকেয়া অর্থের মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা দেওয়ার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়। যা বিদ্যমান ২০ থেকে ৫০ শতাংশের চেয়ে কম।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকের দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এবং এমরানুল হক জানান, তাদের ২ ব্যাংক সম্প্রতি কিছু ঋণ শ্রেণিবদ্ধ করেছে। যেগুলো ২০১৯ সালে নেওয়া শিথিল নীতির ভিত্তিতে পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছিল।

এমরানুল হক বলেন, 'তহবিল আদায়ে কোনো আশার আলো দেখতে না পাওয়ায় আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

নিয়ম শিথিল করার পরও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়নি।

এ বছরের জুনে খেলাপি ঋণের অনুপাত ছিল ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৮ দশমিক ১২ শতাংশে দাঁড়ায়। অনুপাত কমে আসার জন্য মাহবুবুর রহমান সরকারের প্রণোদনা ঋণ বিতরণ কার্যক্রমকে কৃতিত্ব দেন।

তার বক্তব্য, শিথিল নীতির কারণে অনেক ঋণগ্রহীতা এখন ঋণ পরিশোধে অনীহা দেখাচ্ছেন।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুস সালাম আজাদ দাবি করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংক খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। 

সব ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকই এখন সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের বোঝা টানছে। যার পরিমাণ ১৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা।

ব্যাংকটি ১ অথবা ২ সপ্তাহের মধ্যে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আজাদ বলেন, 'এটি আমাদের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মোট খেলাপি ঋণের ৪৭ শতাংশের বেশি আছে ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কাছে। সেপ্টেম্বরে ৩ মাস আগের তুলনায় ব্যাংকগুলোর যৌথ খেলাপি ঋণ শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে ৪৭ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা হয়েছে।

এ সময় ৪১টি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। যা আগের ১ প্রান্তিকের তুলনায় ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে আগের প্রান্তিকে ৯টি বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। যা সেপ্টেম্বরে কমে ২ হাজার ৪৯২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশিরভাগ খেলাপি ঋণ মন্দ ঋণে রূপান্তর হয়ে গেছে। যা খেলাপি ঋণের সবচেয়ে খারাপ শ্রেণি।

এখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের ৮৯ শতাংশই মন্দ ঋণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে, যেসব মেয়াদী অথবা প্রকল্প ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১ বছরেরও বেশি, সেসব ক্ষেত্রে যদি ঋণগ্রহীতারা একটানা ১৮ মাস ধরে কিস্তি পরিশোধ না করেন, তাহলে তা মন্দ ঋণ বলে বিবেচিত হয়।

একইভাবে, যে চলমান ঋণ পরিশোধের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১ বছর, সেই ঋণগ্রহীতারা যদি টানা ১২ মাস কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তা মন্দ ঋণ হিসেবে ধরা হয়।

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Moody's downgrades Bangladesh's ratings to B2, changes outlook to negative

“The downgrade reflects heightened political risks and lower growth, which increases government liquidity risks, external vulnerabilities and banking sector risks, following the recent political and social unrest that led to a change in government,” said Moody’s.

1h ago