‘স্কুল সংবাদপত্র’ কেন প্রয়োজন

ডিজাইন: আফরিন তারান্নুম

ঘটনাটি ২০১৬ সালের। তখন হঠাৎই শুনতে পাই, আমাদের স্কুলে একটি বার্ষিক ম্যাগাজিন হবে, আর সেখানে আমাদের লেখাও ছাপা হবে। আমিও লেখা তৈরি করলাম সেখানে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই আলোচনা শেষ পর্যন্ত আলোচনাই রয়ে গেল। ম্যাগাজিনটি আর হলো না। এর বাইরে স্কুল জীবনে লেখালেখি বা সাংবাদিকতার কোনো অভিজ্ঞতা আমার হয়নি।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা একই। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতি বছর স্মরণিকা করে, আবার হাতেগোনা দুয়েকটি প্রতিষ্ঠানে স্কুলের সাম্প্রতিক ঘটনা ও অর্জন নিয়ে সাপ্তাহিক বা মাসিক প্রকাশনাও রয়েছে। তবে, দুঃখের বিষয় হচ্ছে এর কোনোটির মাধ্যমেই স্কুলে সত্যিকারের সাংবাদিকতার সুযোগ পায় না শিক্ষার্থীরা।

সম্প্রতি আমি একটি অনলাইন সামার ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেছি। সেখানে পরিচিত হয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা যখন তাদের পাঠ্যক্রমের বাইরে নানা বিষয়ে আলোচনা করছিল, তখন বুঝতে পারি যে আমেরিকান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে 'স্কুল সাংবাদিকতা' একটি প্রচলিত ধারণা এবং এর মাধ্যমে তারা অনেক কিছু শিখছে। এমনকি সবচেয়ে কম বাজেট ও কম শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সেখানেও এই বিষয়টি রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের জন্য সাংবাদিকতা হচ্ছে বাস্তব জীবনে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা বিকাশের একটি দুর্দান্ত উপায়। এর মাধ্যমে তারা তাদের লেখালেখির দক্ষতা বাড়াতে পারে, নতুন নতুন তথ্য জানতে পারে, সাম্প্রতিক বিশ্ব সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ রাখতে পারে, এমনকি মতামত বা সম্পাদকীয়র মতো বিভাগ থেকে সমালোচনামূলক ও বিশ্লেষণাত্মক চিন্তার দক্ষতা বিকাশ করতে পারে।

সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসের গল্পগুলোকে তুলে ধরতে শিখলে তা দিন শেষে তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে, তাদের সাংবাদিক দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠবে এবং তারা বাইরের বিশ্বের সমস্যাগুলোও খুব সহজে দেখতে শিখবে। এতে করে তারা সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে যেমন সচেতন থাকবে, তেমনি অন্যকে সচেতন করতে পরবে।

এ ছাড়া, স্কুলের সংবাদপত্র কেবল লেখার জায়গা নয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের আরও নানা ধরনের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ রয়েছে। যেমন: গ্রাফিক ডিজাইন, ছবি আঁকা।

স্কুল সাংবাদিকতা থেকে শিক্ষার্থীরা নানাভাবে লাভবান হতে পারলেও বাংলাদেশে এই ধারণাটি একেবারেই প্রচলিত নয়। এর প্রথম ও সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আমাদের সমাজে শিক্ষাবিদদের ভূমিকা এবং ভালো গ্রেডের অতিমূল্যায়ন। স্কুল জীবনে শুধুমাত্র গ্রেডের জন্য পড়াশোনা করার অর্থ হচ্ছে, একটি সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। কেননা, ভালো গ্রেডের যেমন দরকার, তেমনি দরকার সাম্প্রতিক বিশ্ব সম্পর্কে জানা এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা।

আমাদের স্কুলগুলোতে অর্থায়নের অভাব এর আরেকটি কারণ। দেশের বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষকদের খুব কম বেতন দেওয়া হয়। কাজেই তারা যে পাঠ্যক্রমের বাইরে বেশি কিছু আর করতে চাইবেন না, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, ক্লাসের বাইরে সময় পেলে তাদেরকে অন্য কাজ করতে হয় বাড়তি আয়ের জন্য। কিন্তু শিক্ষার্থীদের লেখা, সেগুলোর বিষয়বস্তু নিরীক্ষণ ও প্রকাশনার মান বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বড়দের অবশ্যই ভূমিকা পালন করতে হবে।

'স্কুল সংবাদপত্রে' অবশ্যই স্বাধীনতা দিতে হবে সাংবাদিকদের, অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের। স্কুলের ভালো দিক যেমন তারা তুলে ধরতে পারবে এই সংবাদপত্রের মাধ্যমে, একইভাবে পর্যাপ্ত প্রমাণসহ তারা স্কুলের খারাপ দিকও এখানে তুলে ধরবে, সেই স্বাধীনতা থাকতে হবে।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীনতম কলেজ সংবাদপত্র 'স্ট্যানফোর্ড ডেইলি'। বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পর্যালোচনা করে এই সংবাদপত্র। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী বাস্কেটবল দলের জয়ের খবর যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি তাদের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি করার অভিযোগও স্থান পেয়েছে। এমন কিছু করা সম্ভব হলে স্কুল সাংবাদিকতা স্কুলে গণতন্ত্র ও সচেতনতা তৈরি এবং তা বজায় রাখার একটি নিশ্চিত উপায় হতে পারে।

নিঃসন্দেহে স্কুলে সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা উচিত। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারবে, নিত্য নতুন জ্ঞানার্জন করতে পারবে এবং সর্বোপরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেতনা ধারণ ও বিকাশের সুযোগ পাবে।

ফাবিহা আফিফা: afifafabiha01@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago