শখে তৈরি শুরু, এখন তিনি দই কারখানার মালিক

নিজ কারখানায় কাজ করছেন মো. নিয়ামুল ইসলাম। ছবি: স্টার

 

বাইরের তৈরি দই, মিষ্টি খেতেন না। তাই বাড়িতে পালা গরুর দুধ বিক্রির পর অবশিষ্ট অংশ দিয়ে শখের বশে দই, মিষ্টি তৈরি শুরু তার। আর এই শখ থেকে এখন তিনি একজন উদ্যোক্তা। প্রতিদিন তৈরি করছেন প্রায় ৩১০-৩৩০ কেজি দই।

তার দইয়ের কারখানায় কাজ করেন ৭ জন শ্রমিক। কারখানায় দুধের যোগান দিতে এলাকার অনেকেই এখন গরু পালন করছেন।

রাজবাড়ী সদর উপজেলার মদাপুর ইউনিয়নের মো. নিয়ামুল ইসলামের (৪০) উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা এমনই।

২০০৫ সালে স্থানীয় হোগলাডাঙ্গী মাদরাসা থেকে কামিল পাস করেন নিয়ামুল। পরের বছর কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক সমস্যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিতে হয় তাকে।

মো. নিয়ামুল ইসলামের কারখানায় তৈরি দই। ছবি: স্টার

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসার পর তিনি বাড়ির পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি গরু পালন শুরু করেন। পরে ২০১০ সালে তিনি স্থানীয় একটি মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

কিন্তু ২০১৪ সালে মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত (মাসিক বেতনের আদেশ) হলে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তার কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করে। পরে এ চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। তখন ২টি গরু পালন ও ঘাস চাষে মন দেন তিনি।

মো. নিয়ামুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি বাইরের দই বা মিষ্টি খেতাম না। বাড়িতে নিজের গরুর দুধ পেতাম ৫ লিটার। প্রতিদিন সব দুধ বিক্রি করতে পারতাম না। ওই দুধ দিয়ে নিজেদের খাওয়ার জন্য আমি বাড়িতে দই-মিষ্টি তৈরির চেষ্টা করি। একসময় বিষয়টি আয়ত্তে এসে যায়।'

'একদিন আমি এলাকার একটি দোকানে কাপ আইসক্রিম ২০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখি। এটা দেখে আমার মনে হলো আমি যদি দই তৈরি করে কাপে বিক্রি করতে পারি, তা হলে কিছু আয় করতে পারব,' বলেন তিনি।

নিয়ামুল বলেন, 'পরে আমি আমার এক পরিচিত দোকানদারের সঙ্গে আলাপ করি। তিনি আমাকে দই বিক্রির বিষয়ে সাহায্য করতে রাজি হন। পরদিন আমি মোট সাড়ে ৩ লিটার দুধ দিয়ে দই তৈরি করে ওই দোকানে সরবরাহ করি। এটি ছিল ২০১৮ সালের শেষদিকের ঘটনা।'

'আমার তৈরি দই খেয়ে অনেকে আমাকে উৎসাহ দেন। এরপর আমি প্রতিদিন বাড়িতে দই তৈরি করতে থাকি,' যোগ করেন তিনি।

পরের ১ বছরের মধ্যে তার তৈরি দইয়ের চাহিদা বেড়ে যায় বলে জানান তিনি।

সে সময় দই তৈরি করতে তার প্রতিদিন ৫০-৬০ লিটার দুধ প্রয়োজন হতো। দই তৈরির কাজে সাহায্যের জন্য একজন লোকও নিয়োগ দেন তিনি।

এরপর থেকে নিয়ামুলকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন প্রতিদিন দই তৈরি করতে তার দুধ প্রয়োজন হয় ৬২০-৬৫০ লিটার। আর এই দুধ সরবরাহ করার জন্য তার এলাকায় বেড়েছে গরু পালনের পরিমাণ।

রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার রাজধরপুর গ্রামের বাসিন্দা সুমন ইসলাম (২৮) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ২০১৬ সালে দুটি গরু দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার খামারে মোট ৩৫টি গরু আছে। তার মধ্যে ১০টি গাভী। এই ১০টি গাভী থেকে আমি প্রতিদিন ১১০-১২০ লিটার দুধ পাই।'

'আগে এই দুধ বিক্রি করতে আমার অনেক সমস্যা হতো। কখনো দুধ নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু পরে নিয়ামুলের দইয়ের কারখানা হওয়ায় আমার মতো খামারিদের সমস্যা সমাধান হয়েছে। আমি প্রতিদিন যে দুধ পাই তা বিক্রি নিয়ে এখন আর চিন্তা করতে হয় না,' বলেন তিনি।

রাজবাড়ী সদর উপজেলার সূরাজদিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. নাজির হোসেন (৪২) ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি কৃষিকাজের পাশাপাশি বাড়িতে ২টি গরু পালতেন। এখন তার মোট ৭টি গরু। তিনিও নিয়ামুলের দইয়ের কারখানায় দুধ বিক্রি করেন।

তিনি বলেন, 'প্রতিদিন দুধ বিক্রি করে নগদ টাকা পাওয়া যায়। তাই আরও অনেক কৃষক বাড়িতে বেশি করে গরু পালন করছেন।'

গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০০-১১০ লিটার দুধ সংগ্রহ করে নিয়ামুলের দই তৈরির কারখানায় সরবরাহ করেন গোবিন্দপুর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস (৪৩)।

তিনি ডেইলি স্টারকে জানান, প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে তিনি নিজের ও আশেপাশের ৩-৪ গ্রাম ঘুরে ৪৫-৪৮ টাকা প্রতি লিটার দরে দুধ কেনেন। পরে সেগুলো ৫০ টাকা লিটার দরে নিয়ামুলের দই তৈরির কারখানায় বিক্রি করেন।

এতে প্রতিদিন তার প্রায় ৫০০-৮০০ টাকা আয় হয় বলে জানান।

নিয়ামুলের কারখানায় বর্তমানে কাজ করছেন মোট ৭ জন কর্মচারী। দই তৈরি থেকে শুরু করে তা বাজারজাতকরণের কাজ করেন এই ৭ জন।

দই কারখানার কর্মচারী ও কালুখালি সরকারি ডিগ্রি কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. সোহান মোল্লা (২২) ডেইলি স্টারকে জানান, তার বাবা একজন কৃষক। বাবার আয় দিয়ে তাদের দুই ভাই-বোনের লেখাপড়া ও সংসার খরচ চালানো কষ্টকর। তাই ৫ মাস আগে ১০ হাজার মাসিক বেতনে কাজ নিয়েছেন নিয়ামুলের দই কারখানায়।

মো. সিদ্দিকুল ইসলাম (২১) নামের আরেক কর্মচারী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দারিদ্র্যতার জন্য বেশি লেখাপড়া করতে পারিনি। তাই দিনমজুরের কাজ করতাম। অন্যের জমিতে কাজ করতাম। কিন্তু প্রতিদিন কাজ পেতাম না।'

এক বছর আগে সিদ্দিকুল কাজ নিয়েছেন নিয়ামুলের দই কারখানায়। এখন তিনি প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা আয় করেন।

কুষ্টিয়া শহরের দই বিক্রেতা সামসুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি গত এক বছর ধরে নিয়ামুলের দই বিক্রি করছেন।

তিনি বলেন, 'নিয়ামুলের দইয়ের অনেক চাহিদা আমাদের এখানে।'

নিয়ামুল জানান, দইয়ের চাহিদা অনুযায়ী তিনি সরবরাহ করতে পারেন না। প্রতিদিন ৫০ কেজি দই উৎপাদন করা গেলে চাহিদা মেটানো যেত। ঈদ বা অন্যান্য উৎসবের সময় চাহিদা আরও বেড়ে যায়।

তিনি জানান, দই বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি ৬ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন। দই বাজারজাত করার জন্য দুটি মোটরসাইকেল ও ১টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনেছেন ৫ লাখ টাকা দিয়ে। আর দই তৈরির কারখানায় ব্যয় করেছেন ৮ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে রাজবাড়ী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফজলুল হক সরদার ডেইলি স্টারকে জানান, নিয়ামুল ইসলাম নিজে যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, তার কারণে স্বাবলম্বী হয়েছে ওই এলাকার আরও অনেকে। নিয়ামুলের দই কারখানায় দুধ সরবরাহ করতে তৈরি হয়েছে বেশকিছু দুগ্ধ খামার।

তিনি বলেন, 'নিয়ামুলকে দেখে ওই এলাকার অনেকে দই তৈরির কারখানা দিয়ে বেকারত্ব দূর করেছেন। নিয়ামুলের মতো উদ্যোক্তা আমাদের দেশে খুব দরকার।'

Comments

The Daily Star  | English
Overall situation of foreign direct investment

Net foreign direct investment hits six-year low

The flow of foreign direct investment (FDI) in Bangladesh fell to $104.33 million in the July-September quarter of fiscal year 2024-25, the lowest in at least six years, as foreign investors stayed away from Bangladesh amid deadly political unrest, labour agitation, and a persistent economic crisis.

13h ago