নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসির মূল্যায়ন: এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ কোথায়

‘নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে ৩৫ শতাংশ নম্বর দেওয়া হবে ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে। কিন্তু আমরা কি আমাদের শিক্ষকদের সেই পরিমাণ স্বাধীনতা, সেই পরিমাণ বেতন দেই? সেই মানের শিক্ষক কি আমরা নিয়োগ দিতে পেরেছি?’

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো শেষ নেই। বছরের পাঁচ মাস চলে যাওয়ার পর বলা হচ্ছে, এসএসসি পরীক্ষার সামষ্টিক মূল্যায়নের লিখিত অংশের ওয়েটেজ (গড় ভারিত্ব) হবে ৬৫ শতাংশ। আর কার্যক্রমভিত্তিক (অ্যাসাইনমেন্ট, অনুসন্ধান, পরিকল্পনা প্রণয়নের মতো হাতে-কলমে কাজ) অংশের ওয়েটেজ হবে ৩৫ শতাংশ।

সম্প্রতি মূল্যায়নের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ–সংক্রান্ত কমিটি যে সুপারিশ করেছিল, এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে লিখিত অংশের ওয়েটেজ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তবে এই সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত না। এখন এনসিটিবি আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করলে এটিকে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পূর্বনির্ধারিত জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় তোলা হবে।

দেশে গত বছর নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়। বর্তমানে প্রাথমিকে প্রথম থেকে তৃতীয় এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমে অধ্যয়ন করছে। পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হবে এটি। সে হিসেবে বর্তমানে যারা নবম শ্রেণিতে পড়ে, তারা নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষা দেবে।

এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা মূল্যায়নটি দ্রুত চূড়ান্ত করার তাগিদ দিয়ে বলছেন, এখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নকাল পাঁচ মাস চলছে। কিন্তু তাদের এসএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন কেমন করে হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত হলো না। যদিও নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ভিত্তিতে হওয়ার কথা।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের সঙ্গে।

এ ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত না হওয়ায় খেদ প্রকাশের পাশাপাশি খোদ নতুন শিক্ষাক্রম নিয়েও মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এই শিক্ষাবিদরা। বলেছেন, শিক্ষার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল খাত নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। আবার নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন কাঠামো নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এখনো অস্পষ্টতা আছে। এমন অস্পষ্টতা থাকলে, শিক্ষকদের ঠিকমতো প্রশিক্ষিত করতে না পারলে এর থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'আমি মনে করি এটা (এসএসসির সামষ্টিক মূল্যায়ন) আরেক বছর পিছিয়ে ইমপ্লিমেন্ট করা উচিত। দুটো অংশ আছে এখানে। একটা লিখিত, আরেকটা প্রাকটিক্যাল। আমি প্রথম থেকেই বলে এসেছি যে পরীক্ষা শতভাগ লিখিত হওয়ার বিষয়টি খুব বিরক্তিকর। এ ক্ষেত্রে সারাবছর পড়ানোর পর একটা দিনে একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেদিন শিক্ষার্থী অসুস্থ থাকতে পারে, বাড়িতে একটা ট্রাজেডি হতে পারে। এমন অসংখ্য কারণে ছেলেমেয়েরা খারাপ করে। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোথাও এমন দৃষ্টান্ত নেই।'

'আরেকটা পদ্ধতি হচ্ছে ধীরে ধীরে বিভিন্ন মূল্যায়নের মাধ্যমে একটা পর্যায়ে আসা। সেক্ষেত্রে কোনো শিক্ষার্থী যদি শেষের পরীক্ষা নাও দেয়, তাহলেও তার সম্পর্কে একটা মূল্যায়ন দাঁড়িয়ে যায়।'

এ পর্যায়ে নিজের শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, 'আমাদের সময়ে টেস্ট পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে এসএসসিতে বসতে পারত না কেউ। ওটাতে আমার দুয়েকটা বন্ধু ফেল করল। একজন আছাড় খেয়ে পা ভাঙল। দ্যাটস টেরিবল, দ্যাটস ক্রুয়েল। এই প্রিটেস্ট কিংবা টেস্ট পরীক্ষা যদি ফরমেটিভ (বছরব্যাপী মূল্যায়ন) হতো তাহলে আসলেই বোঝা যেত যে ছেলেটা যোগ্য। পরীক্ষাটা না দিলেও কোনো অসুবিধা নেই।'

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ভাষ্য, 'থিওরি ইজ ফ্যানটাস্টিক। এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের এখনো কোনো ট্রেনিং হয়নি। তারা জানেন না যে কার্যক্রমভিত্তিক অংশের কার্যক্রমগুলো আসলে কেমন হবে, এটা কারা সমন্বয় করবেন, কীভাবে হবে?'

'বিষয়টা কেবল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানলে হবে না। অভিভাবকদেরও জানতে হবে। কারণ অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে যান টিউশনে। তারাই পয়সা দেন। তাদের অন্ধকারে রাখলে বাচ্চাদের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হবে। সেজন্য একটা বছর সময় নেওয়া হোক। লিখিত অর্থাৎ তত্ত্বীয় অংশটুকুর বিষয়টা ঠিক আছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি কার্যক্রমভিত্তিক অংশে অনেক সমস্যা আছে।'

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'একটা সমস্যা হচ্ছে, সবাই এটার জন্য সমানভাবে তৈরি না। হয়তো যারা বিষয়টা ইমপ্লিমেন্ট করতে চাচ্ছেন, তারা জিনিসটা বুঝেছেন। কিন্তু অ্যাপ্লিকেশন লেভেলে এটা সবাই বুঝবেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। ফলে এটার ওপর জোরেশোরে ট্রেনিং দেওয়া হোক। যেহেতু একটা রিভাইজড ভার্সন এসেছে। এটাকেই আত্মস্থ করার জন্য অন্তত একটা বছর সময় দেওয়া উচিত।'

এ ছাড়া মূল্যায়নটি একবার চালু হয়ে গেলে তা অন্তত ১০ বছর বা পাঁচ বছর চালু রাখার পক্ষে মত দেন মনজুরুল ইসলাম। বলেন, 'যদি কোনো পরিবর্তন আনতেও হয়, দুই-তিন বছর আগে থেকে তার প্রস্তুতি নিতে হবে।'

এই শিক্ষাবিদের বক্তব্য, 'শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত। এটা নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। ভালো এক্সপেরিমেন্ট আমরা অনেক করছি। কিন্তু সমন্বিতভাবে পরবর্তী ধাপে যাওয়া হচ্ছে না। সব একসঙ্গে করে ফেলা যাবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'লিখিত অংশে ৬৫ শতাংশ ভালো। পর্যায়ক্রমে আরও কমাতে হবে। সেটা ১০ বছর পরে করা যাবে। আর যদি দেখি এটাতে সাফল্য আসছে না তাহলে দুই-তিন বছর ৬৫ শতাংশ রেখে চার বছরের মাথায় ৫০ শতাংশে আনা যাবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমানের মতে, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতেই হয়। কিন্তু যেকোনো ধরনের পরিবর্তন আনা হোক না কেন তা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ওই পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই তাদের জানিয়ে দিতে হবে।

তিনি বলেন, 'বলা হয়েছে যে নবম ও দশম শ্রেণির শেষে কিছু কিছু পরীক্ষা হবে। অথচ পাঁচ মাস চলে গেল এখনো তারা জানে না যে নবম শ্রেণির শেষে কী ধরনের পরীক্ষা হবে, দশম শ্রেণির শেষে কী ধরনের পরীক্ষা হবে। নিয়ম হলো তারা নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার আগেই জেনে যাবে তাদের মূল্যায়ন কোন পর্যায়ে কীভাবে হবে, তাতে কী কী থাকবে, কোন ধরনের প্রশ্ন থাকবে, ইত্যাদি।'

মূল্যায়নপদ্ধতি চূড়ান্তকরণে এত সময় নেওয়ার সমালোচনা করে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'এত দেরি করার তো প্রশ্ন ওঠে না। সেই কবে থেকে এই পরিবর্তন শুরু করেছে। এতদিন তো লাগার কথা না। তারা সিদ্ধান্ত নিতে প্রচুর সময় নিয়ে নিচ্ছে।'

এ ছাড়া মূল্যায়নপদ্ধতি চূড়ান্ত করার আগে কোনো ধরনের পাইলটিং না করার সমালোচনাও করেন সিদ্দিকুর রহমান। বলেন, 'যেকোনো ধরনের পরিবর্তন আনার আগে পাইলটিং করতে হয়। এই পরীক্ষা ব্যবস্থাও পাইলটিং করার কথা তাদের। পাইলটিং করলে তার ফলাফল কেমন আসলো, তার ভিত্তিতে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে সেটা তারা আগেই জানতে পারতেন। সবাইকে জানাতে পারতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই পাইলটিংটা করাই হয়নি। অথচ এই সিদ্ধান্তটা আরও এক বছর আগে নেওয়া উচিত ছিল।'

এদিকে খোদ নতুন শিক্ষাক্রমের কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে ৩৫ শতাংশ নম্বর দেওয়া হবে ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে। কিন্তু আমরা কি আমাদের শিক্ষকদের সেই পরিমাণ স্বাধীনতা, সেই পরিমাণ বেতন দেই? সেই মানের শিক্ষক কি আমরা নিয়োগ দিতে পেরেছি? সেই রাজনৈতিক পরিবেশ, সেই সামাজিক পরিবেশ কি তাদের জন্য তৈরি করতে পেরেছি? আমাদের শিক্ষকরা কি স্বাধীনভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার মতো করে তৈরি আছেন?'

এ ক্ষেত্রে নিজের শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতার কথাও জানান এই শিক্ষক। বলেন, 'ক্লাস নাইন-টেন কিংবা কলেজে পড়ার সময় আমাদের জীববিজ্ঞান কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের যে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা হতো, সেখানে সেই শিক্ষকরা কি আমাদের স্বাধীনভাবে নম্বর দিতে পারতেন? আমরা তো দপ্তরিকে টাকা দিতাম, স্যাররা টাকা নিতেন। সেভাবেই নম্বরটা দেওয়া হতো।'

বাংলাদেশের যে সামাজিক অবস্থা, এখানে যে মানের শিক্ষকরা নিয়োগ পান, তাদের ওপর যে রাজনৈতিক চাপ থাকে তাতে ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতার সন্তানকে কোনো শিক্ষক কম নম্বর দিয়ে পার পেতে পারবেন না বলেও মন্তব্য করেন কামরুল হাসান মামুন।

বলেন, 'দুদিন পরপরই তো শুনি নকল করতে না দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ধরে মার দিয়েছে। এখন কনটিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্টে কম নম্বর দিলে শিক্ষকরা পথেঘাটে মার খাবেন। আমাদের সামাজিক অবস্থায় আমরা এখন পর্যন্ত তেমন স্কুল-কলেজ তৈরি করতে পারিনি যে পরিবেশ তৈরি হলে শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে, মাথা উঁচু করে সঠিকভাবে নম্বর দিতে পারবেন।'

কামরুল হাসান মামুন বলেন, 'এখন বরং মনে হচ্ছে এই ৩৫ নম্বরের জন্য শিক্ষকরা বলতে শুরু করতে পারেন যে, "আমার কাছে না পড়লে আমি এই নম্বর দিব না"। কারণ তার বেতন এত কম যে তিনি যেকোনোভাবে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। আমরা যদি ফিনল্যান্ড বা জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলি, তাহলে সেখানকার সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের বাস্তবতার ফারাকও দেখতে হবে। নতুন এই পদ্ধতি কোনোভাবেই আমাদের সমাজের সঙ্গে যায় না। তাই আগে সমাজ তৈরি করতে হবে। তারপর সে অনুসারে ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে হবে।'

Comments