জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ক্যাম্পাসে ঢুকেছিল ‘ট্রাক ভর্তি বহিরাগত’, হল থেকে নেমে আসে হাজারো শিক্ষার্থী

রাত ৩টার পর থেকে এনাম মেডিকেলের জরুরি বিভাগ সংঘর্ষ-হামলায় আহতদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে। একে একে হাসপাতালে আসতে থাকেন আহত শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা।
ছবি: স্টার

সন্ধ্যা থেকে রাতভোর পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ-হামলায় বিভীষিকাময় রাত পার করল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পুলিশ সদস্যসহ আহত দুই শতাধিকের বেশি। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এক শিক্ষক ও চার সাংবাদিকসহ ৩০ জন।

রাতের ঘটনার শুরু ও শেষ

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বঙ্গবন্ধু হল সংলগ্ন এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মিছিলে হেলমেট পরে লাঠি হামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সেখানে শুরু হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। দফায় দফায় রাত ৯টা পর্যন্ত চলে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া সংঘর্ষ। এতে অন্তত ৫০ জন আন্দোকারী শিক্ষার্থী আহত হয়।

পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে জমায়েত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে কিছু সময় সমাবেশ করে রাত সোয়া ৯টার দিকে হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ভিসির বাসভবনের দিকে রওনা হয়। বিচার দাবিতে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান করেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নুরুল ইসলাম আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ১১টার দিকে কথা বলেন।

রাত ১২টার দিকে শিক্ষার্থীদের ওপর হেলমেট পরে লাঠি ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা। শিক্ষার্থীরা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয় ভিসির বাসভবনের ভেতরে। সেসময় ভিসির বাসভবনের সামনের মাঠে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও বহিরাগতরা। পরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ভিসির বাসভবনের আশেপাশের রাস্তায় অবস্থান নেয়।

রাত পৌনে ২টার দিকে ফটক ভেঙে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও বহিরাগতরা লাঠি ও অস্ত্র হাতে আবার ভিসির বাসভবনে চত্বরে ঢোকেন। এ সময় তাঁরা বেশ কয়েকটি পেট্রলবোমা ছোড়েন, ভাঙচুর করেন। ভিসি বাসভবনে ঢুকে আন্দোলনকারীদের নির্মমভাবে পিটিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও বহিরাগতরা। এ সময় উপাচার্য বাসভবনের ভেতরেই ছিলেন।

এরপরই এক অনন্য নজির দেখতে পায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আধা ঘণ্টার মধ্যেই রাত সোয়া ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় হাজারো সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে ভিসির বাসভবনে যান। শেখানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও বহিরাগতদের ধাওয়া দিয়ে পিছু হটতে বাধ্য করেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়ান শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল,  কাঁদানে গ্যাস ও ছররা গুলি ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

ভোররাত ৩টার পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু হয়।

ভোররাতে আহতদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে এনাম মেডিকেল

রাত ৩টার পর থেকে এনাম মেডিকেলের জরুরি বিভাগ সংঘর্ষ-হামলায় আহতদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে। একে একে হাসপাতালে আসতে থাকেন আহত শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা।

ভোর ৫টার দিকে এনাম মেডিকেলের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার আলী বিন সোলাইমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তত ৬০ জন আহত রোগী হাসপাতালে এসেছেন চিকিৎসা নিতে। তাদের মধ্যে ৩০ জন গুলিবিদ্ধ রয়েছেন।'

যা বলছেন আহত সাংবাদিকরা

রাতভর চলা এসব ঘটনায় অন্তত ১১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক আহত হয়েছে। এর মধ্য চারজন গুলিবিদ্ধ। আহত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ডেইলি স্টারের কন্ট্রিবিউটর সাংবা সাকিব।

গুলিবিদ্ধ দৈনিক বাংলার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আব্দুর রহমান সার্জিল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভিসির বাসভবনে ঢুকে আন্দোলনকারীদের মারধর করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা হল থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্রলীগকে ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। সেসময় শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ছররা গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে অনেকেই আহত হয়। আমরা চার গণমাধ্যমকর্মী পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হয়েছি।'

গুলিবিদ্ধ বণিক বার্তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মেহেদি মামুনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

মেহেদি মামুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করেছে। আমরা সাংবাদিক পরিচয় দিয়েছি কিন্তু তারা শোনেনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরব ভূমিকায় ছিল। সাংবাদিকদের ওপর দোষীদের বিচার চাই।

শিক্ষকদের নিন্দা

পুলিশ, ছাত্রলীগ ও বহিরাগতদের হামলায় শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী আহতের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোতাহার হোসেন।

এনাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আজ বহিরাগত, ছাত্রলীগ ও পুলিশ মিলে শিক্ষার্থীদের ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে এর তীব্র নিন্দা জানাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ দায় এড়াতে পারে না। ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার লুৎফল ইলাহী গুলিবিদ্ধসহ দুই শিক্ষক আহত হয়েছেন। প্রতিবাদ জানানোর ভাষা নেই।'

বিক্ষোভে ফুঁসছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা

বৈষম্য বিরোধী কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহফুজুল ইসলাম জিতু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সাধারণত সম্পাদকের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়। নারী শিক্ষার্থীদেরও তারা নির্মমভাবে মারধর করে। ভিসির বাসভবনের সামনে যখন আমরা অবস্থান করছিলাম তখন রাত ১২টার দিকে একবার হামলা হয়। ভিসির বাসভবনের ভেতরে অস্ত্রহাতে হেলমেট পরে ছাত্রলীগ ও বহিরাগতরা হামলা করেন। আমাদের নির্মমভাবে মারধর করা হয়। ভিসি স্যার আমাদের সাথে একবার দেখা করেছেম কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেননি। পরে আমাদের বন্ধুরা বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে আমাদের উদ্ধার করেন। সেসময় পুলিশ আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণ করেছে।'

জিতু আরও বলেন, 'রাতে ট্রাক ভরে বহিরাগতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢোকানো হয়েছে। ভিসির বাসভবনের ভেতরে আমাদের মারধরের সময় সেখানেও ভাঙচুর করে তারা।'

'আজ সারাদিন এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি পালন করব। আমরা শুনেছি আজও বহিরাগতদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এনে আমাদের মারধর করা হবে। এটা আমরা মেনে নেব না। যেকোনো মূল্যই বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করবো।'

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

রাতের ঘটনায় আহত পুলিশ

রাতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) আব্দুল্লাহিল কাফি, সাভার মডেল থানার ওসি শাহজামান, আশুলিয়া থানার ওসি এএফএম সায়েদ সহ অন্তত ১৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস) আব্দুল্লাহিল কাফি বলেন, 'আন্দোলনকারীরা আমাদের ওপর হামলা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস ও ফাঁকা গুলি ছুড়তে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের হামলায় আমিসহ আমাদের ১৫ জন আহত হয়েছি।'

ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাতে ভিসি স্যারের বাসভবনে দুপক্ষ অবস্থান করে ভাঙচুর করলে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।'

আজকের জাহাঙ্গীরনগর

রাতে বহিরাগত সন্ত্রাসী ক্যাম্পাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। একইসঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও ক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

আজ দুপুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহমর্মিতা জানিয়ে আশেপাশের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল মাঠে উপস্থিত হয়েছেন। অপরদিকে গেরুয়া পয়েন্টে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছে। পুলিশ অবস্থান নিয়েছেন ভিসির বাসভবনের পাশে।

আজ দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিস্থিতি চলছিল। যে কোনো সময় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে এমনটা ধারণা করছেন অনেকে।

Comments