কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০১৮

এখনো ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না ছাত্রলীগের হাতুড়ি হামলার শিকার সেই তরিকুল

২০১৮ সালের ২ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালালে গুরুতর আহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম তারেক। ছবি: আরাফাত রহমান

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে ছাত্রলীগের নির্মম হামলার শিকার হয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের তৎকালীন শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম।

ওই বছরের ২ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের সড়কে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বেধড়ক পেটান তরিকুলকে। হাতুড়ি দিয়ে তার ডান পায়ের দুটি হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। মাথায় আটটি সেলাই পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার মেরুদণ্ড।

ওই হামলার পর সোজা পায়ে দাঁড়াতেই তরিকুলের লেগে যায় তিন বছর। কয়েকটি অস্ত্রোপচার করা হয় তার পায়ে। আর ঘটনার ছয় বছর পর আজও তরিকুল জোর পায়ে হাঁটতে পারেন না। এখনো অসহ্য যন্ত্রণা তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।

তরিকুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের আন্দোলনে দাবি ছিল মূলত ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি) কোটা সংস্কার করা। সেই আন্দোলনের জেরে এক পরিপত্রের মাধ্যমে সরকার কোটাব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়। সম্প্রতি এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটার অংশটি বাতিল করেন উচ্চ আদালত। এবার আন্দোলনকারীরা সব গ্রেডে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন।

এই দাবি আদায়ে চলমান আন্দোলনের মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার কুমিল্লা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে পুলিশ। এতে দুই সাংবাদিকসহ আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।

এবার কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর এটাই প্রথম হামলার ঘটনা হলেও, ২০১৮ সালের আন্দোলনে পুলিশের বাধা কিংবা ছাত্রলীগের হামলার বিষয়টি ছিল নিয়মিত ঘটনা।

ফিরে দেখা ২ জুলাই ২০১৮

পূর্বঘোষিত কর্মসূচি সফল করতে সেদিন বিকেলে পতাকা মিছিল বের করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিনোদপুর এলাকা হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছাকাছি এসে পৌঁছালে শিক্ষার্থীদের ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালান আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

ওই হামলায় ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ রাবি শাখার আহ্বায়ক মাসুদ মোন্নাফসহ ১১ জন আহত হন। অনেকে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হলেও রাস্তায় পড়ে যান তরিকুল।

পরে পুলিশের উপস্থিতিতেই রাস্তায় ফেলে তরিকুলকে লাঠি, রড ও হাতুড়ি দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হয়। পরে উপস্থিত সাংবাদিক এবং ছাত্রলীগের কিছু সিনিয়র নেতার অনুরোধে তরিকুলকে পেটানো বন্ধ করে অভিযুক্তরা।

২০১৮ সালের ২ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ছবি: আরাফাত রহমান

গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে তরিকুলকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হামলার ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

পরবর্তীতে দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় তরিকুলকে হাতুড়ি ও লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধরের ছবি বড় করে ছাপানো হয়। পত্রিকার পক্ষ থেকে তরিকুলের ওপর হামলাকারী ১১ জনকে চিহ্নিত করে ছবি প্রকাশ করা হয়; যার মধ্যে ১০ জনই ছিলেন রাবি শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতাকর্মী।

পুলিশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদের শিরোনাম করা হয়- 'রাজশাহী পুলিশ কিছুই দেখেনি'। যদিও সেদিন পুলিশের উপস্থিতিতেই এই সশস্ত্র হামলা করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

সেসময় এই হাতুড়ি হামলার অভিযুক্তদের অন্যতম ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছিলেন, তিনি এই হামলাতে অনুতপ্ত নন। তিনি আরও দাবি করেন, শিক্ষার্থীরাই আন্দোলনে সঙ্গে করে হাতুড়ি, চাপাতি এনেছিলেন।

কিন্তু দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত ছবিতে হাতুড়ি হাতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে দেখা যায় আব্দুল্লাহ আল মামুনকে।

এ ঘটনার পর সারা দেশে নিন্দার ঝড় উঠে। জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের শাস্তির দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।

এখন কেমন আছেন তরিকুল?

ছাত্রলীগের নির্মম হামলার পর দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে জন্ম নেয়া তরিকুল।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে তরিকুলের সঙ্গে কথোপকথনে জানা যায়, তিনি এখন ঢাকার একটি টেক্সটাইল কোম্পানির আইটি সেকশনে কর্মরত। প্রায় দুই বছর হতে চলল তার চাকরিজীবন।

কেমন আছেন জানতে চাইলে তরিকুল বলেন, 'মোটামুটি'। শরীরের অবস্থা জানতে চাইলে জবাব আসে, 'কয়েকবার অস্ত্রোপচারেও স্বাভাবিকভাবে জোর পায়ে হাঁটতে পারি না। দৌঁড়ানো তো দূরের ব্যাপার।'

ছাত্রলীগের হামলার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তরিকুল। ছবি: স্টার

তরিকুল সরকারি চাকরি করতে চেয়েছিলেন। আবেদনও করেছিলেন কয়েকটি পদের জন্য। কিন্তু পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তরিকুল বলেন, 'সেদিনের হামলার পর সোজা পায়ে উঠে দাঁড়াতেই লেগেছে প্রায় তিন বছর। এর মধ্যে চিকিৎসা কীভাবে করাবো সেটাই ছিল মূল চিন্তা। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়টি তো ভাবনাতেও আসেনি। তাই বেশিরভাগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি।'

এতে অবশ্য আক্ষেপ নেই তরিকুলের। বললেন, 'আমি কিংবা আমরা তো কেবল নিজের জন্য আন্দোলন করিনি। আন্দোলন করেছিলাম দেশের জন্য। দেশের মেধাবী যুবসমাজের জন্য। মেধাবীদের জন্য। তারা যাতে বৈষম্যের শিকার না হয়, সে কারণেই আমরা এই যুদ্ধে নেমেছিলাম।'

উচ্চ আদালতের দেওয়া নতুন রায় প্রসঙ্গে তরিকুলের ভাষ্য, 'আমরা তো কখনোই কোটা পুরোপুরি বাতিল চাইনি। সংস্কারই চেয়েছিলাম। অথচ কোটা বাতিল হলো, এখন আবার ফেরতও আনা হলো। এটা মেনে নেয়া যায় না।'

তরিকুল আরও বলেন, 'স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মেধাবী ও যোগ্য সন্তানদের দেশ চালনার আসনে বসাতে হবে। আর তার জন্য সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যুনতম কোটা রেখে কোটা সংস্কার করতে হবে। এটাই আমার চাওয়া।'

সেই হামলার বিচার হয়নি

তরিকুলের ওপর হামলার ঘটনার যথেষ্ট প্রমাণ ছিল। কিন্তু রাজশাহী পুলিশ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেসময় অভিযুক্ত কারও বিরুদ্ধেই ন্যুনতম কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বরং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান আন্দোলনকারীদের 'শিবির' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

 

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

13h ago