জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: প্রশাসন-ছাত্রলীগের ‘আন্ডারস্টান্ডিং’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানকে (ইনসেটে) গত ৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ছিনতাই, নারী নিপীড়ন, মারধরসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায় গত কয়েক বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নাম গণমাধ্যমে এসেছে একাধিকবার।

সর্বশেষ গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দম্পতিকে ডেকে নিয়ে স্বামীকে আবাসিক হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ছাত্রলীগের পাঁচ নেতাকর্মী।

এ ঘটনায় গত কয়েকদিনে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একাধিক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

তাদের মতে, হলে হলে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য এবং প্রশাসনের মদদের কারণেই এ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে চলেছে।

প্রশাসন ও ছাত্রলীগের 'আন্ডারস্টান্ডিং'

সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় প্রক্টর এবং মীর মশাররফ হোসেন হলের (এমএইচ হল) প্রভোস্টের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে প্রভোস্ট এবং প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছেন বিক্ষোভকারীরা।

অন্যদিকে, ধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানসহ অন্যরা অবৈধভাবে আবাসিক হলে থাকতেন। এ ঘটনার পর আবারও আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করার দাবি উঠেছে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, আড়াই হাজারের মতো অছাত্র এখনো হলে থাকছেন।

গত বুধবার নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন জলি বলেন, 'ধর্ষককে যারা পালাতে সাহায্য করেছে তারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিল। কিন্তু প্রক্টর অভিযুক্ত মোস্তাফিজকে খুঁজে আনতে পাঠিয়েছিলেন দুজন ছাত্রলীগ কর্মীকে। তাহলে প্রক্টোরিয়াল টিমের কাজ কী? তাদের উচিত ছিল এমএইচ হলকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে মোস্তাফিজকে আটক করা। কিন্তু পাঠানো হয়েছে দুজন ছাত্রলীগের কর্মীকে। এখান থেকেও বোঝা যায় প্রক্টরের কোনো সদিচ্ছা ছিল না, তাদেরকে আটক করার।'

জাবি ছাত্র ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রশাসন ও ছাত্রলীগের মধ্যে যে 'আন্ডারস্টান্ডিং' সেটা এখানে পরিষ্কার। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ক্ষমতার আধিপত্যের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হলো এই ধর্ষণের ঘটনা। শুধু এমএইচ হলই না, প্রতিটি ছাত্রদের হলেই মাদক চোরাকারবারির সিন্ডিকেট আছে, টর্চারসেল আছে এবং বিপুল সংখ্যক অছাত্ররা রুম দখল করে থাকে। এসবই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চালায়। প্রশাসনের মদদ ছাড়া ছাত্রলীগের এই ক্ষমতা চর্চা সম্ভব না।'

প্রশাসনিক কর্মকর্তা/শিক্ষকদের অনেকেই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'এমএইচ হলের প্রভোস্ট নিজেও ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। এরকম আরও হলের প্রভোস্টরা আছেন। নতুন যারা নিয়োগ পাচ্ছে তাদের অধিকাংশকেই ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ছবি: সংগৃহীত

৫১তম ব্যাচের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব আহমেদ জেনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে—ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যাদের ছাত্রত্ব নাই অথচ হলে আছে তারা এগুলো ঘটাচ্ছে। ক্যাম্পাসে তাদের দাপট অনেক। তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। হিসাব করলে দেখা যাবে, ৪০০ নেতাকর্মীর মধ্যে ৬৭ শতাংশ হচ্ছে অছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে এখানে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে।'

প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করে তিনি বলেন, 'আমাদের প্রক্টর টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা মনে করি, তার আর ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।'

আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রিতু রাবেয়া বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলেই সবার আগে অছাত্রদের হল ছাড়ার দাবি তোলা হয়। প্রশাসনও কিছুদিন পরপরই অছাত্রদের হল থেকে বের করে দেওয়ার নোটিশ দেয়। কিন্তু এর কোনো বাস্তবায়ন আদতে দেখা যায় না।'

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক সাব্বির আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সে রাতে প্রক্টর ও প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাসহ আমি রাত ১১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত হলে ছিলাম। পুরোটা সময় সাংবাদিকরা আমাদের সামনে ছিল। যে তিনটি ছেলে তাদেরকে পালাতে সাহায্য করেছে ওদেরকে তো হল প্রশাসনই ধরিয়ে দিয়েছে। তাহলে আমরা পালাতে সাহায্য করেছি এ ধরনের অভিযোগ কী করে ওঠে?'

'আমি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি এই কারণে আমি তাদের সহযোগিতা করেছি- এই ধরনের কথাবার্তা একেবারেই ভিত্তিহীন। এটা ব্যক্তিসুনাম ক্ষুণ্ণ করারও একটা অপচেষ্টা। সর্বশেষ শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে আমি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কমবয়সি প্রভোস্ট সেজন্য অনেকের জেলাসি থাকতে পারে কিন্তু এটা তো একটা সেনসেটিভ ইস্যু। এরকম একটা ঘটনায় কোনো প্রমাণ ছাড়া অনুমানের ভিত্তিতে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনাটা দুঃখজনক,' বলেন তিনি।

বারবার হল ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হলেও বাস্তবায়ন নেই—এই বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কথাটা অসত্য না। আমরা বহুদিন ধরেই অছাত্রদের বের করার চেষ্টা করছি। হয়ত দুই-চার জন যায়, বাকিরা বের হয় না। এটি আসলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংকট, মূল্যবোধের সংকট। ছাত্রদের মধ্যে সেই মূল্যবোধই তৈরি হয়নি যে পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর হল ছেড়ে যেতে হবে।'

'শুধু রাজনৈতিক সংগঠন না, সব ধরনের ছাত্রদেরই এই সংকট। আড়াই হাজার অছাত্র তো আর রাজনীতি করে না। অনেকে হলে থেকে চাকরির পড়াশোনা করছে, অনেকে আবার অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলে যে অন্য কোথাও থাকার অবস্থা নেই। এই সংকট একদিনে হয়নি, এটা ১৫/২০ বছরের সংকট। সেই জায়গা থেকে আমরা কাজ করছি,' বলেন তিনি।

প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের পালাতে সহযোগিতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই যারা দায়িত্বে থাকেন তাদের দিকে আঙ্গুল ওঠে। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা দায়িত্বে আছেন তারা কী করছেন? ওইদিন রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, আমিসহ সবাই সেখানে ছিলাম। আমরা নিজেরাই তাদেরকে হল থেকে ধরে এনে পুলিশের হাতে দিয়েছি। পুলিশ তো আর তাদের চেনে না। মূল অভিযুক্ত সে পালিয়ে গেল কীভাবে? সেই ফুটেজ তো আমরাই দিয়েছি। আমরাই সেই সহযোগীদের ধরিয়ে দিয়েছি।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ। ছবি: সংগৃহীত

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ঘুরে ফিরে ছাত্রলীগ

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবন ও প্রক্টরের কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিভিন্ন অপরাধে ছাত্রলীগের ৪০ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

২০২২ সালের জুনে পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও আরেক নারী শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে হেনস্তার অভিযোগ ওঠে দুই ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে।

২০২৩ সালের আগস্টে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিনতাইয়ের শিকার হন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) এক সহকারী অধ্যাপক। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।

এছাড়া গত ৯ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বহিরাগত নারীকে শারীরিক হেনস্তার ১০টিরও বেশি ঘটনার খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যার সবকটিতেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়।

অধিকাংশ ঘটনারই বিচার হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি দেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। অনেকে আবার বহিষ্কার হয়েও ক্ষমতার জোরে আবাসিক হলে থাকছেন।

অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগে বরাবরই 'ব্যক্তির দায় সংগঠন নেবে না' এমন বিবৃতি দিয়েছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ কর্মীদের দায় সংগঠন নেবে না বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ও জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তারা কেউ ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠানো হলেও তার উত্তর দেননি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নুরুল আলমকে একাধিকবার কল করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ফোনে টেক্সট পাঠালেও সাড়া দেননি।

Comments

The Daily Star  | English

Netanyahu now a wanted man

ICC issues arrest warrants for the Israeli PM, his former defence chief for war crimes and crimes against humanity; 66 more killed in Gaza

1h ago