ঢাবির হলে ছাত্রলীগের নিয়ম

‘বড় ভাইদের সালাম দিতে হবে, হ্যান্ডশেকের সময় ঝাঁকি দেওয়া যাবে না’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো। প্রতীকী ছবি: স্টার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো। প্রতীকী ছবি: স্টার

'হলের ভেতর এবং বাহিরে বড় ভাইদের সালাম দিতে হবে। সালাম দেওয়ার সময় ডান হাত দিয়ে হ্যান্ডশেক করতে হবে, বাম হাত পেছনে রাখতে হবে। এসময় বড় ভাইদের হাতে ঝাঁকি বা চাপ দেওয়া যাবে না। হাত বুকে রাখা যাবে না।'

'অদ্ভুত' মনে হলেও এটি একটি নিয়ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার নিয়ম। আর এ নিয়মের উদ্ভাবক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ।

শুধু এটিই নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে থাকতে হলে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের অনেকগুলো 'আবশ্যিক' নিয়ম মেনে চলতে হয়। আর এসব নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নয়, বেঁধে দেন ছাত্রলীগের 'বড় ভাইয়েরা'। এসব নিয়মের কোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলেই 'বড় ভাইদের' রোষানলে পড়তে হয়। কখনো কখনো নিয়মের ব্যত্যয়কারীদের 'ম্যানার' শেখানোর নামে 'গেস্টরুমে' নিয়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেন 'বড় ভাইয়েরা'। 'গেস্টরুম' হয়ে উঠে 'টর্চারসেল'।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের 'বড় ভাইদের' লিখিত 'জিয়া হলে থাকতে হলে...' শিরোনামে নিয়মের একটি তালিকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্য পালনীয় ১৪টি নির্দেশনা রয়েছে। সর্বশেষ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, 'হলের যেকোনো ব্যাপারে ইমিডিয়েট বড় ভাইদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।'

এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থীরা জানান, তালিকাটি সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়লেও এটি বেশ আগের। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা যখন হলে উঠতে শুরু করেন, তখন তাদের হলে থাকার 'আদব-কায়দা' শেখানোর নামে ছাত্রলীগের 'বড় ভাইয়েরা' এ তালিকা তৈরি করে দেন। সেসময় ১৪টি নিয়ম মুখস্থ করে রাখতে তা কাগজে ছাপিয়ে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়।

ছাত্রলীগ 'বড় ভাইদের' বাকি নিয়মগুলো হলো- মসজিদ, টিভিরুম, রিডিংরুম, বাথরুম, ক্যানটিন, মেস, ওয়াফাইজোন এবং সেলুন দোকানে সালাম দেওয়া যাবে না। একসঙ্গে অনেক বড় ভাই থাকলে চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী সালাম দিতে হবে। প্রত্যেক বড় ভাই এবং ইয়ারমেটের নাম্বার রাখতে হবে। ছাত্রলীগের সকল প্রোগ্রামে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হবে। সমস্যা থাকলে ইমিডিয়েট বড় ভাইদের বলতে হবে। গেস্টরুমে লুঙ্গি, ট্রাউজার, টিশার্ট ও মোবাইল প্যান্ট পরে আসা যাবে না। এমনকি রাত ১২টার পর এগুলো পরে রুমের বাহিরে আসা যাবে না। ক্যানটিনে প্রথম ৪টি সারিতে বসা যাবে না এবং ক্যানটিন বয়দের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। টিভিরুমের প্রথম সারির চেয়ারগুলোতে বসা যাবে না এবং রিমোট হাতে নেওয়া যাবে না। চেইন অব কমান্ড মানতে হবে। বড় ভাইদের অনুমতি ব্যতীত কোনো রুমে যাওয়া যাবে না। বড় রিডিংরুম ব্যবহার করতে হবে, কোনোভাবেই ছোট রিডিংরুমে প্রবেশ করা যাবে না। হলে ধূমপান করা যাবে না। তবে রুমে পরিবেশ থাকলে ধূমপান করা যাবে। হলে থেকে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো সংগঠন করা যাবে না। যেমন: ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বাম সংগঠন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো সংগঠন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থীরা জানান, এ নির্দেশনা হলের কোথাও এখন আর নেই। প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীরা নিয়মগুলো যাতে মনে রাখতে পারেন, সেজন্য কোনো একসময় এভাবে কাগজে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের 'বড় ভাইয়েরা'। তবে কোনো একটি কাগজ হলের দেয়ালে থেকে গিয়েছিল। এখন হয়তো কেউ ছবি তুলে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

তারা আরও জানান, বর্তমানে হলে লিখিত এসব নিয়ম টানানো না থাকলেও তাদের আবশ্যিকভাবে এসব নিয়ম মেনে চলতে হয়। না মানলে 'বড় ভাইদের' কাছ থেকে শাস্তি পেতে হয়। 

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রতিটি হলেই 'গেস্টরুম' আছে, যেগুলো মূলত অতিথিদের বসার জন্য। তবে ছাত্রলীগ সেগুলোকে 'টর্চারসেল' হিসেবে ব্যবহার করে। প্রায় রাতেই প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের সেখানে ডেকে নেন ছাত্রলীগের 'বড় ভাইয়েরা'। তারপর তাদের ছাত্রলীগ কায়দায় 'ম্যানার' শেখানো হয়। ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচিতে অংশ না নিলে জবাবদিহি চাওয়া হয়। জবাবে সন্তুষ্ট না হলে শিক্ষার্থীদের ওপর চলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, 'নিয়ম না মানলে বড় ভাইয়েরা গালিগালাজ করেন। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেন। সব হলেই প্রায় একই নিয়ম। হলে থাকতে হলে বাধ্য হয়েই সবাইকে এসব নিয়ম মেনে চলতে হয়।'

গেস্টরুমে ছাত্রলীগের 'বড় ভাইদের' নির্যাতনের বিষয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রথমবর্ষের এক শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলে প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

পরে পরিচয় গোপন রাখা হবে প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হলে বাধ্য হয়ে থাকি। ক্যাম্পাসের বাইরে বাসা ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য না থাকায় হলে উঠেছি। এখানে এসে দেখি ছাত্রলীগের বড় ভাইয়েরাই সব। তাদের বাইরে কোনো নিয়ম এখানে খাটে না। প্রশাসনকেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখি না।'

তবে এই তালিকাকে 'সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট' উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হোসেন শান্ত ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ২-৩ দিন ধরে আমাদের হলে মারুফ নামের এক শিক্ষার্থীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগকে কেউ ইস্যু করতে পারেনি। যার কারণে একটি মহল ছাত্রলীগকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে।'

এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ধরনের নিয়ম সম্পর্কে আমি অবগত না। হলে থাকতে হলে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনেই থাকতে হয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Should we believe the mob has govt support?

BNP acting chairman Tarique Rahman yesterday questioned whether the government is being lenient on the killers of Lal Chand, alias Sohag, due to its silent support for such incidents of mob violence.

50m ago