পিএসসির প্রশ্নফাঁস: তদন্তে আরও কয়েকজন বর্তমান, সাবেক কর্মকর্তার নাম

‘একজন বা দুজনের পক্ষে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা সম্ভব নয়। একদল লোক একটি সিন্ডিকেটের মতো কাজ করেছে।’
বিপিএসসি
ছবি: সংগৃহীত

সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আরও কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা জড়িত বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে পিএসসির একজন শীর্ষ ও একজন মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে বিস্তারিত তথ্য থাকলেও স্বাধীনভাবে তথ্য যাচাই করতে না পারায় তাদের নাম গোপন রাখা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, দুর্নীতির অভিযোগে শীর্ষ কর্মকর্তাকে সরকারি অফিসে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। পরে তাকে পিএসসিতে বদলি করা হয়।

পিএসসির ওই মধ্যম সারির কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে অন্তত দুই জন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের চাকরি পান। তাদের মধ্যে একজন পিএসসির মধ্যম পর্যায়ের ওই কর্মকর্তার জামাতা। সূত্র জানায়, বিসিএস ক্যাডার হিসেবে বাহিনীতে যোগদানের আগে তিনি পুলিশের উপ-পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে পিএসসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একজন বা দুজনের পক্ষে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা সম্ভব নয়। একদল লোক একটি সিন্ডিকেটের মতো কাজ করেছে। তদন্তে আমরা বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।'

গত ১২ বছরে বিসিএস পরীক্ষাসহ সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার অন্তত ৩০টি প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই গ্রুপ। গত রোববার ও সোমবার রাজধানী থেকে পিএসসির পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৭ জনকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গ্রেপ্তারের পর এই তথ্য সামনে আসে।

গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের খবর পাওয়ার পর তাদের গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এ ঘটনায় সোমবার রাতে পিএসসির সাবেক এক সহকারী পরিচালকসহ ৩১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে পল্টন থানায় মামলা করা হয়।

গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মঙ্গলবার সাময়িক বরখাস্ত করেছে পিএসসি।

'রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে অন্তত ৫০ জন জড়িত ছিল। তাদের মধ্যে পিএসসির বেশ কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা রয়েছেন,' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন।

তদন্তকারীদের মতে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে অনেকেই পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং তারা এখন বিসিএস ক্যাডারের সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন।

সূত্র জানায়, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে যারা পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তারা এখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, সিন্ডিকেটটি ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার অন্তত ১০ জন পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নফাঁস করেছে এবং তাদের মধ্যে তিন জন বর্তমানে সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ক্যাডারে কর্মরত আছেন। এছাড়া ২৮ ও ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় নির্বাচিতসহ আরও কয়েকজন ক্যাডার কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে তদন্তে।

গ্রেপ্তারকৃত ১৭ জনের মধ্যে ছয় জন মঙ্গলবার ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

জবানবন্দিতে পিএসসির ডিসপ্যাচ রাইডার খলিলুর রহমান বলেন, ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার ১০ পরীক্ষার্থীর কাছে তিনি প্রশ্নফাঁস করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছয় জন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তিন জন মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

খলিলুর আরও জানান, পিএসসির সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতেন তিনি।

সাবেক ওই কর্মকর্তা সবুজ সংকেত দিলে সরকারি চাকরিতে নির্বাচিত হওয়ার জন্য চাকরিপ্রার্থীকে কত টাকা দিতে হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো।

খলিলুর কয়েকজন সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও রেলওয়ে কর্মচারী নিয়োগে ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছেন বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।

২০১২ সালে ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার সময় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে খলিলুরের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা হয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়েছে।

সেসময় র‍্যাব তাকে আটক করে। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন। তাকে চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয়েছিল।

২০২২ সালের মার্চে প্রমাণের অভাবে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়। এরপর থেকে খলিলুর পিএসসির ডিসপ্যাচ রাইডার হিসেবে কাজ করছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিএসসির শীর্ষ কর্মকর্তার মদদে খলিলুর প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হতে পেরেছিলেন।

সিআইডির সাইবার তদন্ত ও অপারেশনের বিশেষ পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গ্রেপ্তার পিএসসির পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে পিএসসি।

ওই পাঁচ জন হলেন উপ-পরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, ডিসপ্যাচ রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহকারী সাজেদুল ইসলাম।

তাদের সম্পদের বিষয়ে দুদককে জানাতেও বলেছে পিএসসি।

এদিকে পিএসসির চাকরিচ্যুত গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ আরও কয়েকজন আসামি জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, ৫ জুলাইয়ের নিয়োগ পরীক্ষার দুই রাত আগে চাকরিপ্রার্থীদের 'রিডিং বুথে' আনা হয়েছিল।

ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করাতে চাকরিপ্রার্থীদের সাভারে একটি ভাড়া বাসা ও রাজধানীর পল্টনে একটি ঘরে আটকে রাখা হতো।

Comments