কোন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি সবচেয়ে নিরাপদ
বিনোদন ও তথ্য প্রবাহের বাইরেও সবার সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংযুক্ত থাকতে আমরা প্রতিনিয়ত সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করি। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মগুলো আসলে কতটা নিরাপদ?
আমরা আজ বড় বড় ৫টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করব, যাতে বোঝা যায় কোনটি সবচেয়ে নিরাপদ আর কোনটি সবচেয়ে অনিরাপদ।
টিকটক
টিকটক বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুসারে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই প্ল্যাটফর্মের গ্রাহক সংখ্যা ৪৬৫ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৮৩৪ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে, যা প্রায় দ্বিগুণ।
কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে এই অ্যাপটি নানা কারণে সমালোচিত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ার দারপ্রান্তে ছিল। কিন্তু টিকটক নিয়ে কেন এত আপত্তি?
অন্যতম প্রধান উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে এই অ্যাপটি গ্রাহকের যেসব তথ্য সংগ্রহ করে, তা নিয়ে। আপনি যদি টিকটক ব্যবহার করেন, তাহলে সম্ভাবনা আছে আপনার ই-মেইল, ফোন নম্বর, অনলাইনে কী করছেন, কোন কোন ওয়েবসাইটে যাচ্ছেন, সেই ওয়েবসাইটের কোন কোন কনটেন্ট দেখছেন, কত সময় ধরে দেখছেন, কোন কনটেন্টগুলো দেখছেন না বা পছন্দ করছেন না, ইত্যাদি প্রচুর ব্যক্তিগত তথ্য টিকটক সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া টিকটকের সফটওয়্যারজনিত দুর্বলতা, অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে, বিশেষ করে চীন সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়েও অনেকের সন্দেহ ও উদ্বেগ রয়েছে।
২০২২ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান টিকটকের ডেটা সংগ্রহের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা অস্ট্রেলিয়ান টিকটক ব্যবহারকারীদের অ্যাপটির 'অতিরিক্ত' তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন, যা ইন্টারনেট ২.০ নামের আরেকটি প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
এ ছাড়া এবিসি নিউজের এক খবর থেকে জানা গেছে, অ্যাপটি ডিলিট করে ফেলার পরেও টিকটক আপনার তথ্য সংগ্রহ চালিয়ে যেতে পারে।
টিকটক অ্যাপে বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা দুর্বলতা রয়েছে, যা সাইবার অপরাধীরা গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে ব্যবহার করতে পারে। 'এইচটিটিপিএস'-এর পরিবর্তে টিকটক 'এইচটিটিপি' ব্যবহার করে, যা আরেকটি উদ্বেগের কারণ।
তবে গ্রাহকের নিরাপত্তার জন্য টিকটকে যেসব ফিচার আছে-
টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন
- রেসট্রিকটেড মোড, যার সাহায্যে অনুপযুক্ত কনটেন্ট ফিল্টার করা যায়
- অবাঞ্ছিত অ্যাকাউন্ট ব্লক করার ক্ষমতা
- কমেন্ট ফিল্টারিং
- প্রাইভেট অ্যাকাউন্ট
এর বাইরেও গ্রাহক যদি কোনো কনটেন্টকে অগ্রহণযোগ্য মনে করেন, তাহলে আলাদাভাবে রিপোর্ট করা যাবে।
ফেসবুক
২০১৮ সালের এপ্রিলে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ মার্কিন সিনেটের শুনানিতে কোম্পানির গোপনীয়তা নীতি এবং সামগ্রিক ব্যবসায়িক কাঠামো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেন। ফেসবুক কীভাবে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করে এবং কোম্পানির সুরক্ষা নীতি সম্পর্কে এই শুনানির মাধ্যমেই বিশ্বের অনেকে জানতে পেরেছেন। শুনানিতে গ্রাহকের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা নীতি সম্পর্কে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন জাকারবার্গ।
কিন্তু এই শুনানি ছিল নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা ইস্যুতে ফেসবুকের কলঙ্কজনক ইতিহাসের একটি ছোট অংশ মাত্র। তথ্য ভখাগাভাগি, তথ্য সংগ্রহ, গ্রাহকের গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং সফটওয়্যারজনিত ত্রুটির মতো বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময় ফেসবুকের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। স্ট্যাটিস্ট্যার তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারী ছিল প্রায় ৩০০ কোটি। বলাই বাহুল্য, ফেসবুক সব সময় বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, বিশ্লেষক ও সচেতন গ্রাহকের ব্যাপক নজরদারিতে থাকে।
ফেসবুকের কিছু অতীতের কেলেঙ্কারির মধ্যে রয়েছে ২০১৮ সালে নিরাপত্তা লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা, ২০২১ সালে অননুমোদিত ফটো-ট্যাগিংয়ের মামলা এবং ২০২২ সালে ব্যবহারকারীর তথ্য ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহারের মামলা। ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অভিযোগ ও মামলার কারণে ফেসবুকের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকেছে এবং ফেসবুক ব্যবহারের সময় আপনার অবশ্যই মনে রাখা উচিত এই কোম্পানিটির গোপনীয়তা রক্ষার রেকর্ড খুবই খারাপ।
তবে ফেসবুকও ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা সুরক্ষা সংক্রান্ত একাধিক সেটিংস ও ফিচার দেয়, যার মধ্যে রয়েছে:
- সিকিউর সকেট লেয়ার (এসএসএল)
- টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন
- লগইন অ্যালার্ট
- সিকিউর ব্রাউজিং
- অন্য ব্যবহারকারীর কাছে প্রোফাইল এবং পোস্ট লুকিয়ে রাখা
- মেসেঞ্জারে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন
- নির্যাতন ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা
- কমেন্ট ফিল্টারিং
ইনস্টাগ্রাম
ইনস্টাগ্রাম একটি স্বাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ২০১২ সালে মেটা এটি কিনে নেয়।
অতীতে একাধিক সাইবার আক্রমনের শিকার হয়েছে এই প্ল্যাটফর্মটি। যেমন, ২০১৭ সালে অ্যাপটির এক ত্রুটির কারণে লাখ লাখ গ্রাহকের ফোন নাম্বার ফাঁস হয়ে যায়।
দ্য ভার্জের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাপের সফটওয়্যারজনিত ত্রুটির সুযোগ নিয়ে হ্যাকাররা লাখ লাখ গ্রাহকের ই-মেইল ও ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে সেগুলোকে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেয়। চলতি বছর অ্যাপটিকে ঘিরে আরেকটি বিতর্ক শুরু হয়, যাতে বলা হয় এটি শিশুদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু নিগ্রহকারীদের এক বিশাল নেটওয়ার্ক আছে ইনস্টাগ্রামে। গবেষনায় দেখা গেছে, ক্ষতিকর ব্যবহারকারীরা অনুপযুক্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট খোঁজার জন্য নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেন এবং তরুণ ব্যবহারকারীরাও এই প্ল্যাটফর্মে অবৈধ কনটেন্ট পোস্ট করছেন।
এখানে বিশেষত উদ্বেগের বিষয় হলো ইনস্টাগ্রাম অ্যাপ নিজেই তার রিকমেন্ডেশন অ্যালগরিদম ব্যবহার করে এই ক্ষতিকর গ্রাহকদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং এসব অবৈধ কনটেন্ট প্রচার করতে সহায়তা করছে। ইনস্টাগ্রামের রিকমেন্ডেশন অ্যালগরিদম আপনার কাছে সে ধরনের কনটেন্টই পাঠাবে, আপনি নিয়মিত যেগুলো দেখেন। ফলে অনেকের কাছে ইনস্টাগ্রাম নিজেই অপ্রাপ্তবয়স্কদের কনটেন্ট পৌঁছে দিয়েছে।
আপনার অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান বা আত্মীয়দের মধ্যে কেউ যদি ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে, তাহলে সব ধরনের নিরাপত্তা চালু আছে কি না, তা নিশ্চিত হয়ে নিন। যেসব টিনেজ সন্তানেরা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারে করেন, তাদের বাবা-মায়ের জন্য ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। এটা অনুসরণ করলে অপনার সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কী কী ভূমিকা নিতে হবে, সে সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।
আপনি প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক- যাই হোন না কেন, নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারটি সব সময়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। নিরাপত্তার জন্য ইনস্টাগ্রামে যা যা আছে-
- টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন
- লগইন অ্যালার্ট
- অবাঞ্চিত কনটেন্ট সরিয়ে ফেলার সুবিধা
- অবাঞ্চিত একাউন্ট ব্লক করার সুবিধা
- সরাসরি মেসেজিংয়ের ক্ষেত্রে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন
- কমেন্ট ফিল্টারিং
টুইটার
টুইটার আরেকটি বৃহত্তম সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, বিশ্বব্যাপী যার কোটি কোটি গ্রাহক আছে। যাইহোক, প্রথমদিকে টুইটারের হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছে এবং লাখ লাখ ব্যবহারকারী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। অতীতে গ্রাহকের তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে টুইটার। যেমন, ২০১৯ সালে গ্রাহকের ই-মেইল ও ফোন নাম্বার ভুলভাবে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে টুইটারের বিরুদ্ধে।
টুইটারের নিরাপত্তা ফিচারগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন
- সরাসরি মেসেজিংয়ের ক্ষেত্রে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন
- অবাঞ্ছিত একাউন্ট ব্লক করার সুবিধা
- কমেন্ট ফিল্টারিং
স্ন্যাপচ্যাট
অল্প বয়সী গ্রাহকদের কাছে স্ন্যাপচ্যাট বিশেষভাবে জনপ্রিয়। অ্যাপটি মূলত ছবি এবং ভিডিওর শেয়ারিং মাধ্যম। তবে গ্রাহকের ছবি ও ভিডিও শেষ পর্যন্ত কোথায় যায়, তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে। আপনার শেয়ারকৃত ছবি ও ভিডিও কি শুধু আপনি এবং প্রাপকের মধ্যেই সাীমাবদ্ধ থাকে? নাকি তৃতীয় কোনো পক্ষ সেগুলো দেখতে পায়, এসব প্রশ্নের সুরাহা হয়নি।
স্ন্যাপচ্যাটে কাউকে পাঠানো ছবি মোবাইলের গ্যালারিতে জমা হয়। কিন্তু অ্যাপের গ্যালারিতেও সেসব ছবি জমা হয়। এই ফিচারটির নাম 'স্ন্যাপচ্যাট মেমরি'। আপনার স্ন্যাপচ্যাট মেমরি আপনি নিজে না দেখালে অন্য ব্যবহারকারীরা দেখতে পারবে না। গ্রাহকের ছবি ও ভিডিও সংরক্ষণের জন্য স্ন্যাপচ্যাট নিজস্ব ক্লাউড স্টোরেজ ব্যবহার করে এবং কোনো গ্রাহক চাইলে ক্লাউড থেকে মেমরি ডিলিট করে দিতে পারে।
ধারণা করা হয়, কিছু কিছু তথ্য সংরক্ষণের জন্য স্ন্যাপচ্যাট গুগলের ক্লাউড সেবা ব্যবহার করে। তবে গুগলের ক্লাউকে কোন কোন তথ্য সংরক্ষিত থাকে, কিংবা 'মেমরি' গুগল ক্লাউডে সংরক্ষিত থাকে কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।
আপনি যদি মেমরি ফিচারটি ব্যবহার নাও করেন, তারপরও স্ন্যাপচ্যাট এই প্ল্যাটফর্মে দেওয়া আপনার সব তথ্যই সংগ্রহ করে।
স্ন্যাপচ্যাটে যেসব নিরাপত্তা ফিচার আছে-
- টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন
- অবাঞ্ছিত একাউন্ট ব্লক করার সুবিধা
- অবাঞ্চিত আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুবিধা
- সরাসরি মেসেজিং এবং মিডিয়া কনটেন্ট মেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন সুবিধা
তাহলে কোনটি বেশি নিরাপদ?
দেখা যাচ্ছে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের নিরাপত্তা ফিচার অন্যদের তুলনায় বেশি। দুটি প্ল্যাটফর্মেরই মালিক মেটা। এ থেকে বোঝা যায়, নিরাপত্তা নিয়ে মেটা বেশি সচেতন। এনক্রিপশন, লগইন সিকিউরিটি অ্যালার্ট এবং নিরাপত্তা ফিচারের সাহায্যে আপনার একাউন্ট নিরাপদ রাখতে পারবেন।
তবে তারপরও ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম নিরাপত্তার দিক থেকে একেবারে আদর্শ নয়। অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলোর মতো গোপনীয়তা লঙ্ঘন, হ্যাকিং এবং তথ্য ফাঁসের ঘটনা এই প্ল্যাটফর্মগুলোতেও ঘটেছে।
সূত্র: মেকইউজঅব
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল
Comments