সন্তানকে প্রথম ফোন দেওয়ার আগে যে বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত
প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে বর্তমানে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জীবনের একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে স্মার্টফোন। তবে আপনার সন্তানের হাতে তার প্রথম ফোনটি তুলে দেওয়ার বিষয়টি অনেক বড় একটি পদক্ষেপ। এই বড় দায়িত্বটি খুবই সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে, প্রথমেই সন্তানের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। যাতে করে, আপনার সন্তানকে যেন কোনো প্রকার অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির মুখোমুখি হতে না হয়।
চলুন তাহলে দেখে নেওয়া যাক, আপনার সন্তানের জন্যে এই প্রযুক্তিটি ব্যবহারের অভিজ্ঞতাকে উপভোগ্য এবং ইতিবাচক করতে যেসব দিক বিবেচনা করা দরকার সে সম্পর্কে।
ফোন কেনার আগে সন্তানের সঙ্গে আলোচনা
শুরুতেই স্মার্টফোনের মালিক হওয়ার অর্থ কী এবং এটি ব্যবহার বিষয়ে আপনার সন্তানের সঙ্গে গভীরভাবে আলোচনা করুন। আপনার সন্তান হয়তো এর আগে প্রায়ই অন্যের ফোন ব্যবহার করেছে। কিন্তু নিজে একটি ফোনের মালিক হওয়া অবশ্যই ভিন্ন এবং এর মাধ্যমে তার ওপর কিছু অতিরিক্ত দায়িত্বও যুক্ত হবে। তাই স্মার্টফোন হাতে তুলে দেওয়ার আগেই কিছু মৌলিক নিয়ম নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।
প্রথমত, আপনার সন্তান প্রতিদিন কতটা সময় ফোনের পেছনে ব্যয় করতে পারবে এবং সেটি কী কারণে তা আলোচনা করে নিন। প্রয়োজন এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করে দিন। যেহেতু, স্মার্টফোন অত্যন্ত আসক্তি-সৃষ্টিকারী একটি প্রযুক্তি। তাই এই ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।
এ ছাড়া তারা কোন কোন অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবে; আপনার অনুমতি ছাড়া নতুন অ্যাপ ডাউনলোড করতে পারবে কিনা এগুলোও পরিষ্কার করে নিন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যোগাযোগ। এ ক্ষেত্রে, তারা কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে কিংবা কোন ধরনের মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করবে, সেগুলোর বিষয়ে আলোচনা করুন। ফোনে অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা নতুন বন্ধু তৈরির ক্ষেত্রে তাদের কি করা উচিত, সে সম্পর্কে নির্দেশনা দিন। প্রয়োজনে আপনাকে বিষয়টি অবগত করতে বলুন।
এ ধরনের আলোচনাগুলো আপনার সন্তানকে তাদের ফোন নিরাপদে ব্যবহার করতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া তারা বুঝবে যে, এটি ব্যবহারের সুবিধাভোগের পাশাপাশি কিছু দায়িত্বও জড়িত আছে।
সন্তানকে জানিয়ে রাখুন, উল্লিখিত নিয়মগুলো পরিস্থিতি অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে। অন্যদিকে, এমন অভিভাবকদের কাছ থেকে পরামর্শ নিন, যাদের আপনার সন্তানের বয়সী ছেলে অথবা মেয়ে আছে।
সন্তানের প্রথম স্মার্টফোন সেটআপ করবেন যেভাবে
আপনার সন্তানের জন্য একটি সেল ফোন সেটআপ করার আগে আপনাকে এর অপারেটিং সিস্টেমের সেটিংস এবং ক্যাপাবিলিটির সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। চাইল্ড মাইন্ড ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আপনার সন্তানের জন্য একটি বিশেষ ফোন দিয়ে শুরু করা উচিত। যেটি শুধু কল এবং টেক্সট করার জন্য ব্যবহার করা যায়।
যদি আপনার বেছে নেওয়া ফোনটির অপারেটিং সিস্টেমে আইওএস বা অ্যান্ড্রয়েড থাকে, তাহলে এর মধ্যে আগে থেকে কী কী আছে তা দেখে নিন। ইনস্টল করা অ্যাপগুলো দেখে সেগুলো রাখবেন কি না ঠিক করুন। অনেক বিক্রেতা আগে থেকে থার্ড-পার্টি অ্যাপ্লিকেশন ইনস্টল করা ফোন বিক্রি করে থাকে। যেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুবান্ধব হয় না।
আপনার সন্তানের হাতে ফোন তুলে দেওয়ার পরেও আপনাকে সেটি পর্যালোচনায় রাখা উচিত। কেন না, অ্যাপল স্টোর কিংবা গুগল-প্লে স্টোর শিশুদের জন্য বিপজ্জনক অ্যাপে পূর্ণ। সেখান থেকে অবাঞ্চিত কোনো অ্যাপ যেন ইনস্টল না করা হয় সেদিক খেয়াল রাখুন।
এ ছাড়া ঘুমানোর সময় 'ডু নট ডিস্টার্ব' বা 'ডিএনডি' ফিচারটি ব্যবহার করুন। যাতে করে ঘুমের সময় বিরক্তিকর বিজ্ঞপ্তিগুলো না শোনা যায়।
শিশুর ফোন ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ এবং সীমাবদ্ধতা
স্মার্টফোন দ্রুত একটি আসক্তিতে পরিণত হতে পারে। তাই আপনার সন্তান কীভাবে এবং কখন এটি ব্যবহার করতে পারবে, সেটি নির্ধারণ করে আপনি এটি কমাতে পারবেন। গুগল ফ্যামিলি লিংক সেটআপ করার মাধ্যমে অভিভাবকরা ১৩ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আপনার সন্তানের বয়স ১৩ বছর হয়ে গেলে আপনি একটি ভিন্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।
এ ছাড়া, নির্দিষ্ট অ্যাপ কতক্ষণ ব্যবহার করা যাবে সেটি অ্যান্ড্রয়েডে নির্ধারণ করে রাখা যায়। আইওএস-এও এরকম বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আপনার সন্তান নির্দিষ্ট অ্যাপগুলোতে কত সময় ব্যয় করবে, তা এগুলোর মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিতে পারেন।
শিশুরা ঘুমানোর কতক্ষন আগ পর্যন্ত তাদের ফোন ব্যবহার করতে পারবে সেটিও আলোচনা করে ঠিক করে নিন। কারণ, বিজ্ঞানীদের মতে ফোনের স্ক্রিনের নীল আলো ঘুমের সময়কাল এবং গুণমানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
অতিরিক্ত নিরাপত্তা
স্মার্টফোনগুলোর মাধ্যমে ছবি, ভিডিও এবং অবস্থানের বিশদ বিবরণ সহজেই প্রকাশ করা যায়। যা অনেকসময়ই অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ ডেকে আনতে পারে। ফেডারেল ট্রেড কমিশন আপনার সন্তানকে অনলাইনে কিছু প্রকাশ বা শেয়ারিং সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে 'প্রাইভেসি-ফার্স্ট' মানসিকতা তৈরির পরামর্শ দেয়। তাদের নিজেদের এবং অন্যদের গোপনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হওয়া অনেক সংবেদনশীল বিষয়বস্তুগুলো জনসাধারণের কাছে পৌঁছানো থেকে আটকাতে পারে।
আপনি একটি থার্ড-পার্টি অ্যাপ দিয়ে আপনার সন্তানের ফোন ট্র্যাক করতে পারেন। বিশেষ করে আপনার বাচ্চা যদি স্কুলের পরে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য বাইরে বের হয়, সে ক্ষেত্রে এটি অতিরিক্ত নিরাপত্তা যোগ করতে পারে। তাদের অবস্থান যাচাইয়ের জন্য আপনি চাইলে তাদের কল করতে পারেন। তবে, তারা যদি ফোন না ধরে কিংবা তাদের উত্তর যদি বিশ্বাসযোগ্য না হয়; সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তার স্বার্থে ট্র্যাকিং অ্যাপ আপনাকে সাহায্য করতে পারে।
আপনার সন্তানের যদি অ্যালার্জি বা কোনো ধরনের অসুস্থতা থাকে, সেক্ষেত্রে অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস-এ চিকিৎসা সংক্রান্ত বিশদ বিবরণগুলো সংরক্ষণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যাতে করে জরুরি পরিস্থিতিতে যারা কাছে থাকবেন, তারা যেন সেগুলো থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারেন।
এই পদক্ষেপগুলো আপনার সন্তানের স্মার্টফোন ব্যবহারের অভিজ্ঞতাকে কিছুটা হলেও নিরাপদ করতে সাহায্য করবে। তবে এটি নিয়ে আপনার খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত হবে না। ফোনের পদ্ধতিগত এবং নিয়মানুযায়ী ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে, আপনার সন্তানের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহারের একটি নিরাপদ অভিজ্ঞতা প্রদান করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র: এমইউও
গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি
Comments