টিকটক নিষিদ্ধ: যুক্তরাষ্ট্র কি হংকংয়ের মডেল অনুসরণ করবে?

টিকটক নিষিদ্ধ: হংকংয়ের মডেল অনুসরণ করবে যুক্তরাষ্ট্র?
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ১৫ কোটিরও বেশি টিকটক ব্যবহারকারী জনপ্রিয় এই অ্যাপ নিষিদ্ধ হতে পারে- এমন এক সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ইতোমধ্যে দেশটির প্রথম অঙ্গরাজ্য হিসেবে মন্টানা এই অ্যাপটিকে নিষিদ্ধ করেছে।

ছোট ছোট ভিডিও শেয়ারের এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে মার্কিন আইনপ্রণেতারা একে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে নিষিদ্ধ করতে চাইছেন। টিকটকের দাবি, তাদের অ্যাপের উদ্দেশ্য শুধু শিক্ষা ও বিনোদন। এর বাইরে তাদের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারকারীরা এখন যে পরিস্থিতিতে আছেন, হংকংয়ের ব্যবহারকারীদের জন্য ২০২০ সালেও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সে বছর থেকে হংকংয়ে টিকটক নিষিদ্ধ।

টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে হংকংয়ে। কিছু ব্যবহারকারী ও কনটেন্ট নির্মাতা তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবে অনেকেই অ্যাপটিতে দৈনিক উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় কাটানো বন্ধ হওয়ায় স্বস্তিও প্রকাশ করেছেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের যে বিশাল সংখ্যক ব্যবহারকারী আছে, তার সঙ্গে হংকংয়ের কোনো তুলনা চলে না।

টিকটক বন্ধ হওয়ায় হংকংয়ের ব্যবহারকারীরা দ্রুতই অন্য সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার শুরু করেছেন এবং তরুণদের মধ্যে অফলাইন যোগাযোগও বেড়েছে। ভবিষ্যতে যদি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ হয়, তাহলে সেখানেও হংকংয়ের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। 

তবে এই সিদ্ধান্ত শিবানী দুখান্ডের মতো টিকটক কনটেন্ট নির্মাতাদের ব্যাপক হতাশ করেছিল। অ্যাপটি যখন হংকংয়ে সেবা বন্ধ করে দেয়, তখন শিবানির ৪৫ হাজার ফলোয়ার ছিল।

২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় স্বাস্থ্য ও রান্নাবিষয়ক ভিডিও করে টিকটকে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন ২৫ বছর বয়সী শিবানী।

তিনি বলেন, 'অনেকেই তখন টিকটকে ভিডিও পোস্ট করছিল। আমরা একে অন্যকে সহায়তা করতাম। গ্রুপ চ্যাটের মাধ্যমে আমরা নিজেদের মধ্যে আইডিয়া ভাগাভাগি করতাম। আমাদের একটি নিজস্ব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল।'

শিবানী জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করেছিলেন। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছিল। নতুন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ব্র্যান্ডগুলো টিকটক কনটেন্ট নির্মাতাদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজও করা শুরু করেছিল।

তিনি বলেন, 'প্রতিদিন নতুন নতুন গ্রাহক যুক্ত হতে থাকলো। টিকটক তখন একটি আনন্দের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে, একদিন সকালে হঠাৎ করেই সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছে।'

'টিকটক যদি এখনো সচল থাকতো, আমি হয়তো আমার ৯টা থেকে ৫টার গতানুগতিক চাকরি ছেড়ে দিতে পারতাম। আমি যদি উন্নতি করার সুযোগ পেতাম, তাহলে টিকটকই হতে পারতো আমার ক্যারিয়ার', যোগ করেন তিনি।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে টিকটক যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে এ যুক্তিই তুলে ধরতে চাইছে। গত মাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে হাজির হয়ে বারবার বলার চেষ্টা করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের বিক্রি ও প্রসারের জন্য টিকটকের উপর নির্ভরশীল। টিকটক বন্ধ করে দিলে এসব ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মার্চ মাসে টিকটক জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫০ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকটক ব্যবহার করে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওমডিয়া'র পূর্বাভাষ মতে, ২০২৭ সালের মধ্যে ভিডিও বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের দিক থেকে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের সম্মিলিত আয়কেও ছাড়িয়ে যাবে টিকটক। এর কারণ হচ্ছে, মানুষ প্রতিনিয়ত টিকটকে বেশি সময় কাটাচ্ছে। তথ্য বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান সেন্সর টাওয়ারের তথ্য অনুসারে ২০২২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী টিকটক ব্যবহারকারীরা দৈনিক গড়ে অ্যাপটিতে ৯৫ মিনিট সময় ব্যয় করেছেন, যা ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

হংকংয়ে টিকটক বন্ধ হওয়ার পর দ্রুতই অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলো সে শূন্যস্থান পূরণ করে নিয়েছে। ইনস্টাগ্রাম 'রিলস' নামের একটি ফিচার চালু করে, যা অনেকটা টিকটকের মতোই। রিলস এখন হংকংয়ে অনেক জনপ্রিয় এবং শিবানীর মতো সাবেক টিকটক কনটেন্ট নির্মাতারও এখন রিলস তৈরি করছেন। যদিও ফলোয়ার আকৃষ্ট করার জন্য তাদেরকে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। শিবানীর এখন প্রায় ১৩ হাজার ফলোয়ার আছে। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরও বাড়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।

তবে এখনো টিকটককে তিনি একটি 'হারানো সুযোগ' হিসেবেই বিবেচনা করেন।

 'টিকটক থাকলে যে পরিমাণ চাকরি, যে পরিমাণ কনটেন্ট তৈরি ও বিজ্ঞাপনের বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকতো.... আমরা সেই সুযোগটি হারিয়েছি।'

সাধারণ মানুষের জন্য টিকটক বন্ধ হওয়াটা ছিল একটি স্বস্তিদায়ক ঘটনা।

পপি অ্যান্ডারসন (১৬) ২০১৮ সাল থেকে টিকটক ব্যবহার শুরু করেন। তার প্রজন্মের অনেকের মতো তিনিও এই অ্যাপটিতে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করতেন।

'টিকটকে পছন্দমতো কনটেন্ট পাওয়াটা ছিল সহজ। কারণ অ্যাপটির অ্যালগরিদমই এটা ঠিক করতো। এটা অনেক বিনোদনমূলক ছিল সত্যি, কিন্তু এখান থেকে আপনি কিছুই পাবেন না।'

টিকটককে তিনি বিষাক্ত পরিবেশ, স্থুল চিন্তাভাবনা, ক্যানসেল কালচার এবং নারীদের প্রতি অবমাননাকর পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী করেন। এমনকি বাস্তব জীবনে তিনি যাদেরকে চিনতেন, তারাও অ্যাপটি ব্যবহার শুরুর পর আচরণ পরিবর্তন করেছিল, ফলে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি।

মার্টিন পুনও (১৫) টিকটক ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন, যদিও তিনি অ্যাপটি ছাড়তে পারছিলেন না।

তিনি বলেন, 'সবাই অ্যাপটি ব্যবহার করছিল। তখন মনে হতো যে আমারও এটা ব্যবহার করতে হবে, সেখানে কী হচ্ছে তা জানতে হবে। আমার মনে হয় এটা আমার জন্য কষ্টকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।'

ভুয়া তথ্য ও নারীবিদ্বেষ ব্যাপকভাবে অ্যাপটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তথাকথিক 'আলফা মেল' অ্যান্ড্রু টেট তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল। নারীদের যৌন হয়রানি এবং পতিতাবৃত্তির অভিযোগে রোমানিয়ার পুলিশ তাকে আটক করেছিল। সম্প্রতি তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গৃহবন্দী অবস্থায় আছেন।

পুন বলেন, 'এসব অ্যাকাউন্টগুলো (অ্যান্ড্রু টেটের মতো) তরুণদের উপর যেভাবে প্রভাব রাখছিল, তা ছিল উদ্বেগজনক।' যদিও পুন স্বীকার করেন যে ভুয়া তথ্য ছড়ানোটা শুধু টিকটক না, সব সামাজিক মাধ্যমেরই সমস্যা।

মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর টিকটকের প্রভাব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছিলেন। একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কখনো কখনো তরুণরা অ্যাপটিতে অ্যাকাউন্ট খোলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আত্মহত্যা ও খাদ্যাভ্যাস সঙ্কট সম্পর্কিত ভিডিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেখানো হয়।'

ধারাবাহিক চাপের মুখে টিকটক সম্প্রতি ১৮-বছর বয়সের নিচের ব্যবহারকারীদের জন্য দৈনিক এক ঘণ্টা ব্যবহারসীমা বেঁধে দিয়েছে। যদিও কেউ চাইলে এই অপশনটি বন্ধ করে দিতে পারে।

তবে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা কথা বলা যেত- টিকটকের এমন কিছু সুবিধার প্রশংসাও করেন অ্যান্ডারসন। তারপরও টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ায় খুশিই হয়েছেন তিনি। টিকটক না থাকাতে এখন রাতে ঘুমানোটা তার জন্য আরও সহজ হয়েছে।

'নিজ থেকে টিকটক দেখা বন্ধ করার মতো আত্মনিয়ন্ত্রণ আমার ছিল না', তিনি বলেন।

টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ায় পুন এবং তার বন্ধু আভা চ্যানের (১৫) জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

২০২০-এ যখন হংকংয়ে টিকটক নিষিদ্ধ হয়, তখনো তারা অনলাইনে ক্লাস করছিল। সামনাসামনি দেখা নেই কারও সঙ্গে। ইনস্টাগ্রাম রিলস এবং ইউটিউব শর্টস তখনও শহরটিতে চালু হয়নি।

চ্যান বলেন, 'টিকটক ব্যবহার না করে কীভাবে সময় কাটানো যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলাম আমরা। তখন আমাদের আগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।'

তার বন্ধুদের মধ্যে যারা টিকটক দেখে সময় কাটাতো, তারা একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া শুরু করলো। নিজেদের আগ্রহের জায়গাগুলো নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে শুরু করলো। ততদিনে করোনা মহামারি সংক্রান্ত কঠোরতাও অনেকটা কমানো হয়েছে। চ্যান, পুন ও তাদের বন্ধুরা নিয়মিত বাইরের কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে থাকলো। এতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন তারা।

এখন হংকংয়ের অনেকেই টিকটকের কথা ভুলেই গেছেন। অ্যান্ডারসন বলেন, 'মানুষ অন্য প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। তারা পেছনে পড়ে নেই।'

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যদি টিকটক নিষিদ্ধ হয়, তাহলে ব্যবহারকারীরা হংকংয়ের মতোই সময়ের সঙ্গে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেবে।

সূত্র: সিএনএন

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

11h ago