যে কারণে বিমানে স্মার্টফোন ‘ফ্লাইট মোডে’ রাখা হয়
'অনুগ্রহ করে আপনার আসনটি আপরাইট (হেলান দেওয়ার অংশটি খাড়াভাবে রাখা) পজিশনে রাখুন, ট্রে টেবিল ভাঁজ করে রাখুন, জানালার পর্দা উঠিয়ে রাখুন, ল্যাপটপ মাথার ওপর বিনে রাখুন এবং ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ফ্লাইট মোডে রাখুন,'- বিমানে চড়ার সময় এই ঘোষণাগুলো আমাদের সবার কাছেই পরিচিত।
প্রথম ৪টি অনুরোধ অনেকটাই যৌক্তিক। বাইরে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলো কি না, সেটা দেখার জন্য বিমানের জানালার পর্দা খোলা রাখা উচিত। ট্রে টেবিল ভাঁজ করে রাখলে এবং আসন আপরাইট পজিশনে রাখলে জরুরি মুহূর্তে দ্রুত আসন ছেড়ে বেরিয়ে আসা যায়। ল্যাপটপ ট্রে টেবিলে রাখলে অনেক সময় বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সেটি নিচে পড়ে যেতে পারে। তাই এটি মাথার উপর বিন বক্সে রাখাটাই শ্রেয়।
বিমান চলাচলে বাড়তি ঝুঁকি এড়াতে মোবাইল ফোন ফ্লাইট মোডে রাখার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এই ঝুঁকিটা আসলে কতটা যৌক্তিক?
প্রযুক্তি অনেকদূর এগিয়েছে
বিমান চলাচল, গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে পাইলটের কিংবা এক বিমানের পাইলটের সঙ্গে অন্য বিমানে পাইলটের যোগাযোগ ব্যবস্থা রেডিও সেবার ওপর নির্ভরশীল। ১৯২০ এর দশক থেকেই নিরাপদ বিমান চলাচলের জন্য এই রেডিও যোগাযোগের মান ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হয়েছে।
৬০ বছর আগে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে তার তুলনায় অত্যন্ত উন্নত ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তিগত ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে বিমানের চলাচল ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো একই তরঙ্গের সিগন্যাল উৎপন্ন হতে পারে, যা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করে।
কিন্তু ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অথোরিটি ও বোয়িংয়ের এক স্বতন্ত্র গবেষণায় দেখা যায়, ফ্লাইটের উড্ডয়ন এবং অবতরণের মুহূর্ত ছাড়া বিমানে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার কোনো বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন বিভিন্ন অবস্থার জন্য বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডউইথ বরাদ্দ রাখার নির্দেশনা জারি করেছে। যেমন- মোবাইল ফোনের জন্য এবং বিমান চলাচল ও যোগাযোগের জন্য আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি। ফলে একটির সঙ্গে আরেকটির সংঘাতের সম্ভাবনা থাকে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোও এই কৌশল গ্রহণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৪ সালেই ফ্লাইটে যাত্রীদের মোবাইল 'ফ্লাইট মোডে' রাখার নির্দেশনা প্রত্যাহার করেছে।
২০২ কোটি যাত্রী
নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ আদর্শ নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও কেন এখনো বিমানে যাত্রীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ? অবাক হলেও সত্যি, এর মূল কারণ নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সীমাবদ্ধতা।
ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ভূমিতে থাকা অনেকগুলো টাওয়ারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। বিমানে ভ্রমণরত যাত্রীরা যদি সবাই ফোন ব্যবহার করতে থাকে, তাহলে টাওয়ারগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ২০২ কোটি যাত্রী বিমানভ্রমণ করেছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় অর্ধেক। তাই গ্রাউন্ড অপারেশন্স থেকে আপত্তি তোলাটা এ ক্ষেত্রে হয়তো যৌক্তিক।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্কের নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। উচ্চ সক্ষমতার ফাইভজি প্রযুক্তি নিয়ে অ্যাভিয়েশন শিল্প সংশ্লিষ্ট অনেকে উদ্বেগ জানিয়েছে।
বর্তমানে অ্যাভিয়েশন শিল্পে যে ব্যান্ডউইথ স্পেকট্রাম ব্যবহৃত হচ্ছে, তা নির্ধারিত সক্ষমতার প্রায় কাছাকাছি। ফলে বিমানবন্দরের কাছাকাছি নেভিগেশন ব্যবস্থায় এটি প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি তৈরি করে।
ফাইভজি প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারে ইতোমধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বিমানবন্দরগুলোর অপারেটররা। তারা বিমানবন্দরের আশেপাশে ফাইভজি নিষিদ্ধের দাবিও তুলেছেন।
অনেক এয়ারলাইন্সই এখন যাত্রীদের অর্থের বিনিময়ে বা ফ্রি ওয়াইফাই সেবা দিচ্ছে। ফলে যাত্রীরা বিমানের ওয়াইফাই দিয়েই মোবাইলে অডিও বা ভিডিও কল করতে পারছেন।
তবে বিমান ক্রুদের জন্য এটি বাড়তি ঝামেলাও তৈরি করেছে। যাত্রীর কী লাগবে, তা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে অনেক কেবিন ক্রুকেই যাত্রীর মোবাইলে কথা বলা শেষ হওয়ার পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ফলে ফ্লাইটের ভেতর নির্ধারিত সেবা সম্পন্ন করতে আগের তুলনায় বেশি সময় লাগছে।
সারকথা হচ্ছে, বিমানে যাত্রীদের মোবাইল ফোন ফ্লাইট মোডে না থাকাটা এখন অতটা ঝুঁকিপূর্ণ না, এটা সত্যি। তবে বিমানে ওয়াইফাই সেবার ফলে বিমান ক্রুদের কাজ শেষ করতে বাড়তি সময় লাগছে।
সূত্র: সিএনএন
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল
Comments