কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

চ্যাটজিপিটি বনাম গুগল ট্রান্সলেট: অনুবাদে কে বেশি দক্ষ?

চ্যাটজিপিটি বনাম গুগল ট্রান্সলেট: অনুবাদে কে বেশি দক্ষ?
ছবি: সংগৃহীত

অনলাইনে বিনামূল্যের অনুবাদ টুলগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা একটি টুল গুগল ট্রান্সলেট। তবে নতুন করে বাজারে আসা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি কি এর স্থান দখল করবে? 

কনটেন্ট রাইটিং এবং প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে প্রোডাক্ট ডিজাইন, ডাটা অ্যানালাইসিস-সহ প্রায় প্রতিটি ডিজিটাল ক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলেছে চ্যাটজিপিটি।

চ্যাটজিপিটি একটি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে। তা হলো অনুবাদে। যদিও বর্তমানে এক্ষেত্রে খুব কম মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে এবং গুগল ট্রান্সলেট এই ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত শীর্ষে অবস্থান করছে। 

তবে চ্যাটজিপিটির উত্থানের সঙ্গে গুগল ট্রান্সলেটের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের শিকার হবে কি না এরকম আশঙ্কাও প্রকট হচ্ছে। দেখে নেওয়া যাক কোন টুলটি এখন পর্যন্ত অনুবাদের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে-

একটি ভালো অনুবাদ দেখতে কেমন?

অনুবাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো একটি ভাষা ব্যবহার করে অন্য আরেকটি ভাষায় লিখিত বা কথ্য কোনো কথার অর্থকে ঠিকঠাকভাবে বোঝানো। যার কারণে, একটি ভালো অনুবাদের জন্য কেবল দুটি ভাষার মধ্যকার শব্দগুলোর আক্ষরিক অর্থ অদলবদলই যথেষ্ট নয়। বরং বিষয়টির মূল অর্থ বা অনেক ক্ষেত্রে ভাবানুবাদটিও বোঝাতে হবে।

ভালো অনুবাদের জন্য তাই অবশ্যই কোনো একটি কথা বা লেখার একবারে আক্ষরিক অনুবাদ হওয়া কাম্য নয়। সেজন্যে সেটির স্বর, সাংস্কৃতিক অর্থ এবং প্রসঙ্গ সংরক্ষণ করে মূল অর্থটি প্রদান করতে হবে।

তবে দুর্ভাগ্যবশত গুগল ট্রান্সলেটের মতো বড় অনুবাদ পরিষেবা থেকেও একটি ভালো অনুবাদ পাওয়া কঠিন। মূলত মেশিন অনুবাদের বিষয়টিই এখন পর্যন্ত কঠিন। কারণ বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে ভাষাগুলোর মাঝে অনেক পার্থক্য থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফরাসি ভাষায় সর্বনামের লিঙ্গ রয়েছে। অন্যদিকে জাপানি ভাষায় সর্বনামগুলো প্রায় সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। একইভাবে চীনা ভাষায় বিশেষ্যর একবচন বা বহুবচনের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। ইংরেজিতে সেটি সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই দুটি ভাষার মধ্যে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে এ রকম বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ কাজ করে।

তারপরে প্রসঙ্গ এবং কথোপকথনের সমস্যা রয়েছে। মেশিন অনুবাদের টুলগুলো কোনো একটি কথার বা টেক্সটের প্রসঙ্গ সঠিকভাবে খুঁজতে বেশ মুশকিলে পড়ে। একই বিবৃতি এক প্রসঙ্গে এক জিনিস এবং অন্য একটি প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জিনিস বোঝাতে পারে।

একইভাবে কথোপকথনের মাঝে যদি কোনো প্রবাদ, বাগধারার মতো বিষয় থাকে। তাহলে মেশিন অনুবাদের ক্ষেত্রে সে বিষয়টি অনুবাদ করতে বেশ সমস্যা হয়ে থাকে।

চ্যাটজিপিটি লেখার অনুবাদ বেশ ভালোভাবেই করতে পারছে। তাই এটি গুগল ট্রান্সলেটের সঙ্গে কতটুকু পেরে উঠবে সেটিই আজকের দেখার বিষয়। দুটি টুলের তুলনা করার জন্য এক্ষেত্রে কিছু লেখা নির্বাচন করা হয়েছে যেগুলো অনুবাদ করা বেশ কঠিন। 

গুগল ট্রান্সলেট বনাম চ্যাটজিপিটি: চলিত ভাষা বা সাধারণত কথোপকথনের অনুবাদ

কথোপকথন অনুবাদের সময় অনুবাদটি মূল ভাষার মতো একই সুরে অর্থ এবং অভিপ্রায় সংরক্ষণ নাও করতে পারে।

প্রথমে গুগল ট্রান্সলেট এবং চ্যাটজিপিটিকে একটি সহজ ইংরেজি বাগধারা 'জুয়ান কিকড দ্য বাকেট' স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করতে বলা হয়। এক্ষেত্রে উভয় অনুবাদ পরিষেবাই 'জুয়ান পেটো এল ব্লেড' অনুবাদ করে। যা এই বাগধারাটির আক্ষরিক অনুবাদ। তাই এক্ষেত্রে যারা এর প্রসঙ্গটি বুঝবে না, তাদের ক্ষেত্রে এর মূল অর্থ বা অভিপ্রায়টি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যাবে।

অনুবাদের পর এখানে গুগল ট্রান্সলেট আর তেমন কোনো সাহায্য করে না। কিন্তু চ্যাটজিপিটি এ ক্ষেত্রে আরও কিছু সহায়তা প্রদান করে। চ্যাটজিপিটিতে আপনি শুধু অনুবাদ করতে বলার বাইরেও বেশ কিছু বিষয় করতে পারবেন। আপনি কোন ভাষায় অনুবাদ করছেন তার ওপর নির্ভর করে আপনি চ্যাটজিপিটিকে 'স্প্যানিশ ভাষায় এর অর্থ' অথবা 'ইংরেজিতে এর অর্থ প্রদান করতে' বলতে পারেন। এই ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটি বাগধারাটির আক্ষরিক অনুবাদ এবং পাশাপাশি ব্যাখ্যাও প্রদান করবে।

আরও বেশ কিছু কথোপকথন অনুবাদের চেষ্টা করা হলে দেখা যায় উভয় পরিষেবাই প্রায় সবসময় একটি আক্ষরিক অনুবাদ প্রদান করছে। যদিও সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চলে, কিন্তু কিছু কিছু পরিস্থিতিতে সেগুলো বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে কথোপকথনের আক্ষরিক অনুবাদের পাশাপাশি একটি 'ব্যাখ্যা' প্রদান করার ক্ষমতা চ্যাট জিপিটিকে এদিক দিয়ে এগিয়ে রেখেছে। 

কিন্তু এক ধরনের অনুবাদ দিয়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিত নয়। তাই এ ক্ষেত্রে আরও কঠিন কিছু বাগধারা দেওয়া হয়। প্রথমে একটি ফিলিপিনো বাগধারা ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে উভয় টুলের জন্যেই এটি বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু এখানে গুগল ট্রান্সলেট একটু এগিয়ে থাকে।

এরপরে আরও কঠিন অনুবাদের দিকে যাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মালয়ালম ভাষা নির্বাচন করা হয়। কাজটি ছিল মালয়ালম ভাষার একটি মোটামুটি জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে একটি উদ্ধৃতি অনুবাদ করার।

চ্যাটজিপিটি এটি চেষ্টা করলে দেখা যায়, জটিল মালায়লাম অনুবাদ কিংবা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা চ্যাটজিপিটির একটি দুর্বল দিক।

অন্যদিকে গুগল মোটামুটি ভালোভাবেই তা অনুবাদ করতে পেরেছে।

যদিও দুটি টুলের একটিও সেটি নিখুঁতভাবে করতে পারেনি। তবে গুগল অনুবাদ মোটামুটি কাছাকাছি গিয়েছিল। তবে গুগল অনুবাদের দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও, চ্যাটজিপিটি অনুবাদের পাশাপাশি বাগধারার অর্থও করতে পারে। যা একটি বড় লেখা অনুবাদ করার সময় খুবই উপযোগী। যেখানে একাধিক বাগধারা রয়েছে। এই ধরনের ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থে একটি বাগধারা অনুবাদ করা বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। 

গুগল ট্রান্সলেট বনাম চ্যাটজিপিটি: অনুবাদের যথার্থতা

মূল লেখার সঙ্গে অনুবাদের সূক্ষ্ম কোনো পার্থক্য পুরো লেখাটির অর্থই সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দিতে পারে। তাই দেখে নেওয়া যাক, গুগল ট্রান্সলেট এবং চ্যাটজিপিটির মধ্যে অনুবাদের যথার্থতা বা সঠিকতা কোনটি কতটুকু বজায় রাখতে পারছে। 

এ ক্ষেত্রে প্রথমে চীনা দর্শন সম্পর্কিত একটি সহজ লেখা দেওয়া হয়। যার সবচেয়ে নিকটতম অনুবাদের অর্থ দাড়ায়, 'এই ভণ্ড সমাজে, প্রকৃত ব্যক্তিত্ব একটি বিরল এবং মূল্যবান সম্পদ।' এ ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটি এবং গুগল ট্রান্সলেট উভয়ই একদম সঠিকভাবে এটি অনুবাদ করে এবং তাদের অনুবাদে কোনো পার্থক্য ছিল না।

পরবর্তীতে ফিলিপিনোতে একটি অনুবাদের কাজ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মূল লেখাটি ছিল একটি জটিল শব্দের খেলার অংশ। এ ক্ষেত্রে দুটি টুলই নিখুঁতভাবে অনুবাদ করতে পারেনি। তবে চ্যাটজিপিটি যতটা সম্ভব কাছাকাছি এসেছিল। সেখানে গুগল ট্রান্সলেট অনুবাদটির সম্পূর্ণ বিপর্যয় না ঘটালেও এটি মূল বার্তার সূক্ষ্মতা সঠিকভাবে ধরতে পারেনি।

গুগল ট্রান্সলেট বনাম চ্যাটজিপিটি: ক্রেওলস অনুবাদ

ক্রেওল এমন ধরনের ভাষা যেগুলো অন্যান্য ভাষা থেকে অনেক শব্দ ধার করে গঠিত। যার কারণে সেগুলো অনুবাদ করা খুব কঠিন। এক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটি এবং গুগল ট্রান্সলেট উভয়কেই পশ্চিম আফ্রিকায় কথিত 'পিডগিন ইংলিশ' নামের একটি ক্রেওল ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

যদিও গুগল ট্রান্সলেট 'পিডগিন ইংলিশ' কিছু পরিমাণে বোঝে। কিন্তু এখানে পরীক্ষামূলকভাবে যে লেখাটি দেওয়া হয়, গুগল সেটি অনুবাদ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। সমস্যার একটি কারণ হলো ইংরেজি শব্দের উপস্থিতি। গুগল ট্রান্সলেটের ক্রেওলকে ইংরেজি থেকে আলাদা করার ক্ষমতা সীমিত।

যদিও নিখুঁত নয় কিন্তু চ্যাটজিপিটি-এর ব্যাখ্যা এই ক্ষেত্রে বেশ স্পষ্টভাবেই বক্তার অর্থ এবং অভিপ্রায় জানাতে সক্ষম হয়েছিল। 'পিডগিন ইংলিশ'-এর প্রাসঙ্গিকতার প্রকৃতি বিবেচনা করলে ফলাফলটি খুবই চমৎকার।

গুগল ট্রান্সলেট বনাম চ্যাটজিপিটি: কার অনুবাদ টুলটি বেশি ভালো?

এটা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। উভয় অনুবাদ টুলেরই তাদের নিজস্ব শক্তিশালী দিক রয়েছে। গুগল প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ বা এনএলপিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে আসছে। যার ফলে যে ভাষাগুলোতে গুগল বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে সেগুলোতে এটি চ্যাটজিপিটিকে  ছাড়িয়ে যায়৷ তবে চ্যাটজিপিটি যেভাবে কাজ করে এবং এটির প্রশিক্ষণের প্রকৃতি যদি বিবেচনা করা হয়। তাহলে এটি অনুবাদের ক্ষেত্রে একটি অনন্য এবং বেশ আকর্ষণীয় পদ্ধতির দ্বার উন্মোচন করেছে। 

তাহলে আপনার কোনটি ব্যবহার করা উচিত? উভয় টুলই এখনো বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। তাই নির্দ্বিধায় দুটিই পরখ করে দেখুন এবং যেটি আপনার জন্য সুবিধাজনক সেটিই ব্যবহার করুন।

একটি উদীয়মান অনুবাদের টুল, চ্যাটজিপিটি

মেশিন ট্রান্সলেশনের ক্ষেত্রে গুগল ট্রান্সলেট নিজের জন্য একটি নাম তৈরি করতে পেরেছে। অন্যদিকে চ্যাটজিপিটি তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও একে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। চ্যাটজিপিটির সবচেয়ে বড় সুবিধাগুলোর মধ্যে একটি হলো, এটি ব্যবহারকারীর দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এর অনুবাদ করতে সক্ষম। যা গুগল ট্রান্সলেট এখনো করতে পারে না।

যদিও আমরা সুনিশ্চিতভাবে এখনো বলতে পারি না, পছন্দের অনুবাদ টুল হিসেবে চ্যাটজিপিটি গুগল ট্রান্সলেটের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে কি না। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই চ্যাটবটটি স্পষ্টতই গুগলের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে।

 

তথ্যসূত্র: এমইউও
গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

9h ago