বিখ্যাত মানুষের নামে ৫ সুপারকার

বিখ্যাত মানুষের নামে ৫ সুপারকার
ছবি: সংগৃহীত

দুবাই কিংবা সৌদি আরব, মানালি থেকে হংকং— বিশ্বের নামিদামি সব শহরের রাস্তায় ভিড় জমে সুপারকারের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা কন্টেন্ট আকারে বেশ পরিচিত। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান ধনাঢ্য শ্রেণির ভিড়ে অতি ধনিকদের বিশেষত্ব জাহিরে তাদের গাড়িটিকে স্বতন্ত্র পরিচয় বহনে সক্ষম হতে হয়। 

অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোর কাছে সীমিত আকারে জনপ্রিয় মডেলের বিশেষ সংস্করণ বের করার মোটামুটি নিয়মিত একটা চর্চা হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সম্মানিত করা, মার্কেটিং, অন্যান্য সব মডেলের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নির্মাতাদের মেধা, ক্রিয়েটিভিটি এবং সক্ষমতার যাচাই করার একটি নিখুঁত প্ল্যাটফর্ম এই বিশেষ সংস্করণ। খুবই ইউনিক নকশায়, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে, বিশেষ সুবিধার এবং বিরল ও মূল্যবান উপাদানে নির্মিত এসব বিশেষ সংস্করণের মডেলগুলো বের করতে সুপারকার কোম্পানিগুলোর সবচেয়ে মেধাবী কর্মীদেরও অন্তত ৪ থেকে ৫ বছর সময় লাগে। 

প্রকৌশলীদের মেধা ও মননের নিপুণ পাণ্ডিত্যের এসব সুপারকারকে অনেকে হাইপারকার নামেও চিনে থাকে। এসব গাড়ির অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নামকরণ। যেসব বিখ্যাত ব্যক্তির নাম সুপারকারের মডেলের সঙ্গে জড়িত তারা হয় কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, কিংবদন্তী পর্যায়ের রেসিং ড্রাইভার কিংবা অটো ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট কিংবদন্তিতুল্য। এসব বিশেষ ব্যক্তি ও তাদের নামে বিদ্যমান বিরল ৫টি সীমিত আকারের বিশেষ সংস্করণের সুপারকার নিয়েই আজকের আলোচনা।

পাগানি হুয়াইরা বিসি (বেনি কায়োলা)

আর্জেন্টাইন বংশোদ্ভূত ইতালিয়ান গাড়ি ব্যবসায়ী হোরাশিও পাগানির জীবনী কিংবদন্তীতুল্য। আর্জেন্টিনার প্রান্তিক গ্রাম থেকে উঠে আসা পাগানির নিজের নামে সুপারকার ইন্ডাস্ট্রিতে আলাদা পরিচিতি তৈরি করা খুব সহজ বিষয় না। আর্জেন্টিনার ছোট্ট দোকানে বসে দেখা স্বপ্নকে তাড়া করে ফরাসি রেনল্টে চাকরি লাভ। 
 
সেখান থেকে পাগানি ছুটে যায় ইতালিতে, যেখানে ল্যাম্বরগিনির একদম নিচের স্তরে চাকরি নিয়ে এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলীতে পরিণত হন। ল্যাম্বরগিনিকে সুপারকারে কার্বন ফাইবার নিয়ে কাজ করতে পাগানি একটি অটোক্লেভ কেনার প্রস্তাব দেন, যা কোম্পানিটি প্রত্যাখ্যান করে।

ল্যাম্বরগিনির চাকরি ছেড়ে পাগানি নিজের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। পাগানির ক্যারিয়ারের এই সংগ্রামী সময়ে তার ওপর আস্থা না হারানো মানুষটির নাম বেনি কায়োলা (বিসি)। ফোর্বস ম্যাগাজিন যাকে বিশ্বের অন্যতম স্বতন্ত্র ফেরারি সংগ্রাহক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইতালিয়ান এই উদ্যোক্তা ছিলেন পাগানির প্রথম গ্রাহক। যাকে সম্মানিত করতেই প্রতিষ্ঠানটি পাগানি হুয়াইরা বিসি মডেলটি বের করে।  

কোম্পানির তথ্যমতে মডেলটির মাত্র ২০ ইউনিট নির্মিত হয়েছি, যদিও বিভিন্ন সূত্রে সংখ্যাটা ৩০। বিশেষ সংস্করণের এর প্রতিটি গাড়িই মার্সিডিজের এমজি ভি১২ টুইন-টার্বো ইঞ্জিনে নির্মিত যা ৭৫০ হর্স-পাওয়ারেরও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। গাড়ির সাসপেনশন, ব্রেক, চাকা, টায়ার এবং অ্যারো-ডাইনামিকস সবই প্রচলিত হুয়াইরা থেকে উন্নত করা হয়েছিল। পাগানির বিশেষ সংস্করণের এই একটি গাড়ি কিনতে কম করে হলেও ১৪ লাখ ডলার খরচ করতে হবে।

বুগাটি ভেইরন এট্টোরে বুগাটি

বিশেষ সংস্করণের সুপারকার নিয়ে আলোচনাতে বুগাটির নাম থাকবে না তা তো হয় না। 'বুগাটি ভেইরন এট্টোরে বুগাট্টি-কে বলা চলে সুপারকার জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুপারকারের একটি। চিরন্তন আইকন বনে যাওয়া এই মডেলটি আর উৎপাদিত হয় না। অটোমোবাইল জগতে প্রভাবশালী জার্মান ভক্সওয়াগন (ভিডব্লিউ) গ্রুপের মালিকানাধীন লাক্সারি ব্র্যান্ড হিসেবে আছে পোর্শে, বেন্টলি, অডি, ল্যাম্বরগিনি ও বুগাটির মতো ব্র্যান্ড। বুগাটির বিক্রি করা প্রতিটি ভেরনের জন্য ক্ষতি হয়েছিল ৬২ লাখ ডলারের বেশি, যা পোষাতে বিভিন্ন বিশেষ সংস্করণ বের করেছে কোম্পানিটি। সীমিত সংস্করণের গাড়ির মধ্যে একটি ছিল ২০১৩ সালের ভেরন এট্টোরে বুগাটি।

বুগাটির প্রতিষ্ঠাতা এট্টোরে বুগাটির নামেই এই বিশেষ সংস্করণটি বের করা হয়েছিল। যা মূলত ভেরন গ্র্যান্ড স্পোর্ট বিটেজি'র ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। সুপারকার জগতে বুগাটির কিংবদন্তী সিরিজের অংশ হিসেবে ৬টি বিশেষ সংস্করণ বের করা হয়েছিল, যার একটি ছিল এট্টোরে বুগাটি। এই গাড়ির বডি আংশিকভাবে হাতে পালিশ করা অ্যালুমিনিয়াম এবং নীল কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি। 

গাড়িটির নকশায় ১৯৩২ সালের বুগাটি টাইপ-৪১ রয়্যাল-এর ছাপ পাওয়া যায়, যার চেসিস নম্বর ৪১১১১। এই গাড়ির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাতার ভাস্কর ভাই রেমব্রান্ট বুগাটিকে শ্রদ্ধা জানাতে রেডিয়েটর ক্যাপে একটি 'নৃত্যরত হাতি'র মূর্তি ব্যবহৃত হয়েছে। সিরিজের অন্য সংস্করণের মতো এই গাড়িতেও ১২০০ হর্সপাওয়ার বিশিষ্ট ৮ লিটারের ডব্লিউ ১৬ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ২ দশমিক ৬ সেকেন্ডে ১০০ কিলোমিটার (প্রতি ঘণ্টা) গতি উঠাতে সক্ষম এই গাড়ির সর্বোচ্চ গতি প্রায় ৪০৯ কিলোমিটার (প্রতি ঘণ্টা)। ক্রেতাকে সীমিত সংস্করণের প্রতিটা গাড়ি কিনতে অন্ততপক্ষে ৩১ লাখ মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছে।

ফেরারি এনজো

এনজো ফেরারি, এই নামটাই সব কিছু বলে দেয়। বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাসম্পন্ন সুপারকার কোম্পানি ফেরারি। ইতালিয়ান মালিকানাধীন যা এখনো স্বতন্ত্র একটি কোম্পানি হিসেবে টিকে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন খ্যাতনামা রেসার এনজো ফেরারি নির্মাণ করেছিলেন বর্তমান সুপারকার জায়ান্ট 'ফেরারি' কোম্পানি। ২০০০ সালের শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠাতাকে সম্মান জানাতে ইতালীয় এই গাড়ি প্রস্তুতকারী এফ-১ চালিত ৬ লিটারের প্রাকৃতিকভাবে অ্যাসপিরেটেড ভি-১২ চালিত ৪৮৫ পাউন্ড-ফুট টর্কের একটি গাড়ি বাজারে আনে। যা ফেরারি এনজো নামেই পরিচিত। 

গাড়িটি ৬৫১ হর্স-পাওয়ার বিশিষ্ট, যা প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ৩ দশমিক ১৪ সেকেন্ডে শূন্য থেকে ৬০ মাইল গতি উঠাতে সক্ষম, মাত্র ৬ দশমিক ৬ সেকেন্ডে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতি উঠানো গাড়িটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২২১ মাইল। এখন পর্যন্ত এই মডেলটির মাত্র ৪৯৩টি গাড়ি উৎপাদিত হয়েছে। যার দাম ছিল শুরুতে ৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার। যদিও ফেরারির এই আইকনিক মডেলটির বর্তমান দাম ৩০ লাখ ডলারের বেশি।

মার্সিডিজ-বেঞ্জ এসএলআর ম্যাকলরেন স্টার্লিং মস

বর্তমানে বিখ্যাত ব্রিটিশ ম্যাকলরেন অটোমোটিভ কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠার আগে, ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মার্সিডিজের সঙ্গে যৌথভাবে মার্সিডিজ বেঞ্জ এসএলআর ম্যাকলরেন গাড়ি নির্মাণ করেছে। মার্সিডিজের ব্যানারে মোট ২ হাজার ১৫৭টি গাড়ি নির্মিত হলেও তার মধ্যে ৭৫টি গাড়ি ছিল একটু বিশেষ ধরনের। বিখ্যাত ব্রিটিশ ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভার স্যার স্টার্লিং মসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০০৯ সালে এসএলআর ম্যাকলরেন স্টার্লিং মস সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল। 

এই সংস্করণটি মার্সিডিজের ৩০০ এসএলআর রেস কার দ্বারা অনুপ্রাণিত, ১৯৫৫ সালে এই গাড়ি দিয়েই স্যার স্টার্লিং মস মিল মিগলিয়া মটর-স্পোর্টে জয়ী হয়েছিলেন। স্যার মস তখন তার সহকারী চালক ডেনিস জেনকিনসনকে নিয়ে ৯৯০ মালের বিপজ্জনক সড়কে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৯৭ দশমিক ৯৬ মাইল গতিতে গাড়ি চালিয়ে রেকর্ড করেছিলেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই মার্সিডিজ-বেঞ্জ এসএলআর ম্যাকলরেন স্টার্লিং মস সংস্করণ বের করা হয়।

এই সংস্করণটি স্পিডস্টার স্টাইলিং বৈশিষ্ট্যযুক্ত, গাড়িটিতে ছাদ ও উইন্ড-স্ক্রিন নেই। অত্যন্ত লম্বা হুডের নিচে একটি সুপারচার্জড ৫ দশমিক ৪ লিটার এএমজি ভি৮ ইঞ্জিন রয়েছে, যা ৬৪০ হর্স-পাওয়ার বিশিষ্ট। মাত্র সাড়ে ৩ সেকেন্ডের মধ্যে ঘণ্টা শূন্য থেকে ৬২ মাইল পর্যন্ত গতি তুলতে সক্ষম। গাড়িটির সর্বোচ্চ গতিসীমা ২২০ মাইল (প্রতিঘণ্টা)। কার্বন ফাইবার উপাদানের নির্মিত সংস্করণটি অনন্য স্ট্যান্ডার্ড এসএলআর কুপের চেয়ে প্রায় ৪৪০ পাউন্ড বেশি হালকা। যে কেউ চাইলেই এই গাড়িটির মালিক হতে পারবে না। যাদের কাছে মূল এসএলআর এর একটি গাড়ি আছে, সেসব মালিকরাই বিশেষ এই সংস্করণটির মালিক হতে পারবেন। যার প্রতিটির জন্য অবশ্য ১০ লাখ ডলারের বেশি ব্যয় করতে হবে।

ল্যাম্বরগিনি গালার্ডপো এলপি ৫৫০-২ ভ্যালেন্তিনো বেলবনি

শুধু প্রতিষ্ঠাতা কিংবা রেসারের নামেই সুপারকারের নামকরণ হয়নি, দীর্ঘকালীন কর্মীদের নামেও বিশেষ সংস্করণের মডেল বের হতে দেখা গেছে। ইতালিয়ান ল্যাম্বরগিনি গালার্ডপো এলপি ৫৫০-২ ভ্যালেন্তিনো বেলবনি যার মধ্যে অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটিতে ৪ দশকের কর্মী, টেস্ট ড্রাইভার ভ্যালেন্তিনো বেলবনির নামেই এই সুপারকারটি বের করা হয়েছিল। কোম্পানিটির দীর্ঘকালীন প্রোডাকশনে থাকা এই মডেলটির ভ্যালেন্তিনো বেলবনি মডেলটির মাত্র ২৫০টি গাড়ি নির্মিত হয়েছিল।

ভি-১০ ইঞ্জিনবিশিষ্ট ৫৪২ হর্স-পাওয়ার সম্পন্ন গাড়িটি ৪ সেকেন্ডেরও কম সময়ে ঘণ্টায় ৬২ মাইল গতি তুলতে সক্ষম। যা ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৯৯ মাইল গতিতে চলতে পারে। গাড়িটির কেন্দ্র বরাবর একটি স্ট্রাইপ এবং সাইড উইন্ডোর নিচের একটি ব্যাজ দ্বারা বেলবনি সংস্করণ শনাক্ত করা সম্ভব।

তথ্যসূত্র: কারবাজ, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট 
 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

17h ago