আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩

নকআউট ম্যাচে অতি সতর্ক অ্যাপ্রোচই কাল হলো ভারতের?

পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে আগ্রাসী ব্যাটিং, কিন্তু নকআউট রাউন্ডের মহা গুরুত্বপূর্ণ লড়াইতে এসে নিজেদের আমূল বদলে ফেলা, গুটিয়ে রেখে অতি সতর্ক হওয়া। আড়ষ্ট এই অ্যাপ্রোচ শেষ পর্যন্ত হয়েছে বুমেরাং।

নকআউট ম্যাচে অতি সতর্ক অ্যাপ্রোচই কাল হলো ভারতের?

নকআউট ম্যাচে অতি সতর্ক অ্যাপ্রোচই কাল হলো ভারতের?

পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে আগ্রাসী ব্যাটিং, কিন্তু নকআউট রাউন্ডের মহা গুরুত্বপূর্ণ লড়াইতে এসে নিজেদের আমূল বদলে ফেলা, গুটিয়ে রেখে অতি সতর্ক হওয়া। আড়ষ্ট এই অ্যাপ্রোচ শেষ পর্যন্ত হয়েছে বুমেরাং। বিশ্বকাপ ফাইনালে রোহিত শর্মা যদিও আগ্রাসী খেলেছেন কিন্তু তার বিদায়ের পর বদলে গেল ছবি। জড়তা পেয়ে বসল ভারতের গোটা ইনিংসে। গত কয়েক বছরে নকআউটের ম্যাচে ভারতের ব্যাটিংয়ে এটি নিয়মিত দৃশ্য।

২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর অধিনায়ক রোহিত ও কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের যাত্রা শুরু। তখন তারা আক্রমণাত্মক ক্রিকেটেই বিশ্বাসের কথা শোনান। আগ্রাসী ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলতেও থাকে রোহিতের দল। ২০২১ বিশ্বকাপ থেকে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মাঝের যে সময়, সেখানে ভারতের চেয়ে দ্রুতগতিতে রান তুলতে পারেনি আর কোন দলই। রোহিতরা ওভারপ্রতি ৯.৩২ রান করে এনেছিলেন এই সময়ে। সেই ভারত ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে গিয়ে মুখোমুখি হল ইংল্যান্ডের।

প্রথম দশ ওভারে তারা তুলল কিনা মাত্র ৬২ রান! রোহিত খেললেন ২৮ বলে ২৭ রানের ইনিংস। বিরাট কোহলি ৪০ বল খেলে করতে পারলেন মোটেই ৫০ রান। শেষমেশ হার্দিক পান্ডিয়ার ৩৩ বলে ৬৬ রানের ইনিংসে ভারত গড়তে পারে ১৬৮ রানের পুঁজি। যা চার ওভার হাতে রেখেই ইংল্যান্ড পেরিয়ে যাওয়ার পর কোচ দ্রাবিড় বলেন, আরও ১৫-২০ রান বেশি করা উচিত ছিল তাদের। তার মানে যে রান করা যেত অ্যাডিলেইডের পিচে, সেটি থেকে বেশ কমেই আটকে গিয়েছিল ভারত। লম্বা সময় ধরে আগ্রাসনের ঝাণ্ডা উড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়েই কিনা সেই ঝাণ্ডা নেমে গেল হুট করে। ২০২৩ বিশ্বকাপে ধারাভাষ্যে সেই দলের সদস্য দীনেশ কার্তিক ছিলেন। কার্তিক ধারাভাষ্যের একটা সময়ে বলেন- রোহিত শর্মাও নাকি তাকে পরে বলেছিলেন, ওই দিন (ইংল্যান্ড ম্যাচের দিন) আমাদের আরও আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত ছিল।

২০২৩ বিশ্বকাপের ফাইনাল পর্যন্ত রোহিত খেলে গেছেন সমানতালে। পাওয়ার প্লেতে দেড়শর বেশি স্ট্রাইক রেটে খেলে নকআউটের দুটি ম্যাচেই এনে দিয়েছেন উড়ন্ত সূচনা। সেমিতে ৩১ বলে ৪৭ রানের পর ফাইনালে রোহিত করেন ২৯ বলে ৪৭। সেমিফাইনালে পাওয়ার প্লেতে ভারত এনেছিল ৮৪ রান। ফাইনালে করে ৮০ রান, এরপরের ৪০ ওভারে আনতে পারে মোটে ১৪০ রান। ৪০ ওভারে মারতে পারে মাত্র চারটি বাউন্ডারি (যার দুটি আবার মোহাম্মদ সিরাজ ও মোহাম্মদ শামির ব্যাট থেকে)। গত ১২ বছরে ওয়ানডেতে শেষ চল্লিশ ওভারে এত কম বাউন্ডারি মারেনি আর কোনও দল!

দিনের বেলা আহমেদাবাদের পিচ বেশ ধীরগতির ছিল। বল পুরনো হওয়ার পর রান করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রিভার্স সুইং পর্যন্ত পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা। কন্ডিশন কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা বোলিংও করেছেন অসাধারণ। ট্রাভিস হেডও পরে বলেছিলেন, রাতের দিকে ব্যাটিং সহজ হয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যাটিংয়ের সময় পিচ যতই কঠিন হোক না কেন, ভারত কি সেই খোলস থেকে বেরুতে চেষ্টা করেছে?

ইএসপিএনক্রিকইনফোর হিসাবের মারফতে জানা গেল, মাঝের ত্রিশ ওভারে ১৮০ বলে ভারত বাউন্ডারির চেষ্টা করেছে মাত্র ৯ বার। মাত্র ৯ বার! এত কম চেষ্টার কারণে প্রশ্ন উঠবেই। কোচ রাহুল দ্রাবিড় যে ব্যাখ্যা দিলেন এর কারণ হিসেবে, সেটিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যদিও। যখনই জুটি গড়ে আক্রমণে যেতে পারে, তখনই উইকেট হারিয়ে বসে আবার পুনরুদ্ধারের কাজে নেমে পড়তে হয়েছে তাদের- দ্রাবিড় বলেছেন সেটাই। কোহলি ও লোকেশ রাহুলের জুটি ৬৭ রানে ভেঙে যায়। রাহুলের সাথে রবিন্দ্র জাদেজার জুটি ৩০ রানের বড় হয়নি। সূর্যকুমার যাদবের সাথে রাহুলের জুটিও ২৫ রানেই শেষ হয়ে যায়। ১০৭ বলে ৬৬ রানে খোলস থেকে বেরুনোর আগেই আউট হয়ে যান রাহুল।

ভারতকে বেঁধে রাখতে অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের দুর্দান্ত বোলিং চেঞ্জের সাথে ফিল্ডিংও রেখেছে অবদান। কামিন্স তার অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারেরই সেরা একটা দিন পার করেছেন। ফিল্ডসেটে সবকিছুর জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি দেখিয়েছেন। শুরুতে তুলে মেরে খেলতে পছন্দ করা আগ্রাসী রোহিতের জন্য প্রথম থেকেই, ডিপ পয়েন্ট ও ডিপ স্কয়ার লেগ রেখে ঘটনা ঘটার আগেই প্রস্তুত থেকেছেন। যদিও রোহিতের অসাধারণত্বে ৪৭ রানের আগে রুখতে পারেননি তাকে।

নিজে দশ ওভারে ৩৪ রানের স্পেল করেছেন কোন বাউন্ডারি না দিয়েই। লেগ সাইডে বাড়তি একজন ফিল্ডার স্কয়ার লেগে রেখেছেন। সাধারণত দুজনের বদলে লেগ সাইডের ইনফিল্ডে তিনজন রেখে আটকে দিয়েছেন ভারতের ব্যাটারদের। স্কয়ার লেগের ওই ফিল্ডার যথেষ্টই কাজে এসেছেন। ধীরগতির পিচে স্লোয়ারের সাথে শর্ট লেংথের মিশ্রণে কষ্টকর করেছেন ব্যাটিং। কন্ডিশন মোতাবেক একেবারে পারফেক্ট বোলিংই করেছেন অস্ট্রেলিয়ানরা।

বোলিং চেঞ্জেও নৈপুণ্য দেখিয়েছেন কামিন্স। মাঝখানে এক ওভারের স্পেলে বোলারদের বোলিং দিচ্ছিলেন। ১৮তম থেকে ২৬তম ওভার- এই নয় ওভারের মধ্যে ছয় বোলারকে বোলিংয়ে এনেছিলেন। তার মধ্যে টানা দুই ওভার করাননি পাঁচজনকেই। পরে সংবাদ সম্মেলনে কারণ হিসেবে বলেছেন- টেস্টে ফিল্ডসেট আর বোলিং পরিকল্পনায় বদল এনে কাজ করতে হয়, এখানে সে সময় নেই তাই এক ওভারের স্পেল দিয়ে ব্যাটারদের সেট হওয়ার সময় না দিয়ে ছন্দ পেতে দেননি।

পাওয়ার প্লের পর অস্ট্রেলিয়াকে কখনো চাপেই ফেলতে পারেনি ভারত। মাঝের ত্রিশ ওভারে তাদের মাত্র ৫ শতাংশ বলে বাউন্ডারির চেষ্টা বলে দেয়, তারা চাপে ফেলার যথেষ্ট চেষ্টাও করেননি। অথচ কী দারুণভাবে দেখা যায়, একটা-দুইটা বাউন্ডারিতেই বোলারদের লাইন-লেংথে হেরফের করতে! কিন্তু ভারত বসে বসে দেখেছেই যেন। আর দুর্দান্ত বোলিং করা অস্ট্রেলিয়ার থেকে সুযোগও পায়নি। শেষমেশ তাই বসে থাকতেই হয়েছে। ইনিংস ২৪০ রানে শেষ হয়ে যাওয়ার পর দ্রাবিড় আফসোস করেছেন আরও ৩০-৪০ রানের। রোহিতও আরও রানের আক্ষেপ করেছেন।

পিচ কঠিন হলেও রান তারা রেখে এসেছেন, কোচ-অধিনায়কের মুখে একই আফসোস। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও যেমনটা হয়েছিল। এবার আরেকটি বিশ্বকাপের আসল সময়েই তারা ঢুকে গেল খোলসে। নকআউট ম্যাচে রক্ষণশীল মনোভাবে আটকা পড়েই আরেকবার হলো হৃদয়ভঙ্গ।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina regime silenced media

Chief Adviser's Press Secretary Shafiqul Alam yesterday said steps must be taken to ensure that no one can directly interfere with the media in the future like it was done during the ousted Sheikh Hasina government.

6h ago