আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩

আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে উজ্জ্বল এক পরিবারের গল্প

মুজিব উর রহমান ও ইব্রাহিম জাদরান। উভয়ে একই পরিবারের সদস্য, সম্পর্কে তারা মামাত-ফুপাতো ভাই। নূর হলেন মুজিবের মামা ও ইব্রাহিমের চাচা। তিনি আফগানিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ২০০৯ সাল থেকে।

আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে উজ্জ্বল এক পরিবারের গল্প

আফগানিস্তান কেবল অংশ নেওয়ার জন্যই বিশ্বকাপে আসেনি। তাদের অসাধারণ পারফরম্যান্সেই সেটা ফুটে ওঠে। চারটি ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে ওঠার দৌড়ে ছিল তারা। সেই স্বপ্নও পূরণ হয়ে যেত, যদি না গ্লেন ম্যাক্সওয়েল নামক এক অস্ট্রেলিয়ান দানব বাধা হয়ে দাঁড়াতেন! শেষমেশ গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও আফগানরা মন জয় করেছেন বিশ্বের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমীর। তারা সামনে দলটির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখছেন।

ক্রিকেট— সার্বিক বাস্তবতায় অন্ধকারের মাঝে আফগানিস্তানের জন্য যেন এক টুকরো আলো। রশিদ খান, মোহাম্মদ নবিদের মুখেই শুনতে পাওয়া যায় তা। আফগানিস্তান বিশ্বমঞ্চে খেলতে নামলে তাই দেশটির জনগণ চোখ মেলে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর নূর আলী জাদরান দেখবেন একটু বাড়তি গর্ব নিয়ে। তার পরিবারের দুই ছোট সদস্য যে লড়েন আফগানিস্তানের জার্সিতে। নূরের গড়া স্বপ্নের রথে চড়েই আবার তৈরি হয়েছেন সেই দুজন।

তাদের নাম মুজিব উর রহমান ও ইব্রাহিম জাদরান। উভয়ে একই পরিবারের সদস্য, সম্পর্কে তারা মামাত-ফুপাতো ভাই। নূর হলেন মুজিবের মামা ও ইব্রাহিমের চাচা। তিনি আফগানিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ২০০৯ সাল থেকে। তার মানে, একই পরিবারের তিনজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার।

মিস্ট্রি স্পিনার মুজিবের বয়স যখন তিন মাস, তখনই বাবাকে হারান। পিতৃহারা মুজিবের বেড়ে ওঠা এরপর নানাবাড়িতে। নয় বছর বয়সী মুজিব টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পান তার মামাকে। নূর তখন খেলছিলেন ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। মামাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চে দেখে মুজিবের মনে ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্নের ঘর তৈরি হয়। টেপ-টেনিস বলে আগে থেকেই খেলতেন মুজিব। এরপর থেকে মন দিলেন 'আসল' ক্রিকেট বলে।

মুজিবের ভাগ্য ভালো, একটা উদ্যোগের কথা নূরের মাথায় আসে ওই সময়ের কাছাকাছিতেই। শুধু কি নিজে খেলবেন? বংশ পরম্পরায়ই ক্রিকেটের বীজ বুনে দেওয়ার ব্যবস্থা করাও তো দরকার। ভবিষ্যত প্রজন্মকে ক্রিকেটের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নূর। বিশাল আকারের বাড়িতে দুই হাজার বর্গমিটারের মতো জায়গা ছিল তাদের পশুপাখি পালন ও অতিথিদের জন্য। সেখানে নূর যোগ করলেন ক্রিকেটীয় সুবিধা। নেট প্রস্তত করা হয়ে যায় ২০১১ সালের দিকে। 

বোলিংয়ের প্রেমে পড়া মুজিব বল করতেন নূরকে। আরেকজনও তাদের সঙ্গে যোগ দিতেন, তিনি ইব্রাহিম। নূরের ভাতিজা ইব্রাহিম। চাচাকে দেখে আফগানিস্তানের এই ওপেনারেরও ক্রিকেটের স্বপ্ন বোনা। ২০১০ সালের ওই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ফিফটি হাঁকিয়েছিলেন নূর। সেটাই মূলত ইব্রাহিমের ক্রিকেটের অনুপ্রেরণার উৎস।

চাচা নূর নিজের পাওয়া স্পন্সরের ব্যাট থেকে রেখে দিতেন ইব্রাহিমের জন্যেও। প্যাড, থাই গার্ড ওসবও পেতেন ইব্রাহিম। চাচার খাতিরে ছোট বয়স থেকেই তিনি ব্যবহার করে এসেছেন উন্নতমানের ক্রিকেটীয় সামগ্রী। ভাতিজা ও ভাগ্নেদের জন্য নূরের তৈরি করা ক্রিকেট একাডেমিতে তারা বেড়ে উঠতে থাকেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুজিবের অভিষেক হয়ে যায় আগে। ২০১৭ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর পরের বছরই বাকি দুই ফরম্যাটে পা রাখেন মুজিব। এরপর ২০১৯ সালে একে একে সব ফরম্যাটে অভিষেক ঘটে ইব্রাহিমের। একইসাথে বেড়ে উঠে আন্তর্জাতিক আঙিনায়ও পথচলা শুরু হয় দুই ভাইয়ের।

এ পর্যন্ত মুজিব খেলে ফেলেছেন ৭৪ ওয়ানডে ও ৪৩ টি-টোয়েন্টি। তার পিছু পিছু ইব্রাহিমও ২৮ ওয়ানডে ও ২৪ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। ধীরে ধীরে দুজনেই হয়ে উঠেছেন আফগানিস্তান দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। একই পরিবারের এই দুজনের দিকে আফগানিস্তানও তাকিয়ে তাকে আশা ভরা চোখে।

দুই ভাই একসাথে নিজেদের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, নূরের পরিবার সেটা এখন নিয়মিতই দেখে আসছে। এখন পর্যন্ত মুজিব ও ইব্রাহিম, দুজনে একসাথে নেমেছেন মোট ৫১ ম্যাচে। ২৮ ওয়ানডে ও ২৩ টি-টোয়েন্টিতে ২০টি জয়ের অংশও হয়েছেন। সেসব জয়ের দুটি আবার এসেছে বিশ্বমঞ্চেই। 

আফগানিস্তান বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে প্রথম জয় পায় চলমান ২০২৩ বিশ্বকাপে এসেই। নিজেদের তৃতীয় বিশ্বকাপে ওই জয় আসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৯ রানে। সেদিন ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন ৫১ রানে ৩ উইকেট নেওয়া মুজিব। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে ঐতিহাসিক জয়ের পর পাকিস্তানকেও তারা হারিয়ে দেয় ৮ উইকেটে। ওই জয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ ৮৭ রান করা ইব্রাহিম। বিশ্বকাপে পরে শ্রীলঙ্কা ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও জয় পায় আফগানরা।

তবে ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়— এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানের ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় দুই জয়। সেই দুই জয়েই ম্যাচসেরা হয়ে সবচেয়ে বড় অবদান মুজিব ও ইব্রাহিমের, দুই ভাইয়ের, নূরের ভাগ্নে ও ভাতিজার। নূরের জন্য এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে! তার ওই নেট, তার ওই নেটের অনুশীলনের দিনগুলো— আফগানিস্তানের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা দুই জয়ের দুই কারিগরের জন্ম দিল! 

সেমিফাইনালের সম্ভাবনা জাগানোয় ২০২৩ বিশ্বকাপ স্মরণীয় হয়ে থাকবে আফগানদের জন্য। সেই যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন মুজিব ও ইব্রাহিম। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩৭৬ রান করেছেন ইব্রাহিম, যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ উইকেট নিয়েছেন মুজিব।

আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে দারুণ অবদান রাখতে পেরেছেন ভেবে নূর সগর্বে হয়তো বাকি জীবন পার করে দিতে পারবেন! নিজে ২০০৯ সালে অভিষেকের পর ৫১ ওয়ানডে ও ২২ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। তাছাড়া, এখনও ক্রিকেটেই মজে আছেন নূর। চলতি বছরের অক্টোবরেই যে এশিয়ান গেমস হলো, সেখানে নূর খেলেছেন আফগানিস্তানের হয়ে।

এর আগে ইমার্জিং এশিয়া কাপেও খেলেছেন ৩৫ বছর বয়সী ডানহাতি ওপেনার নূর। আফগানদের গতবারের বিশ্বকাপ দলেও ছিলেন। ২০১৯ বিশ্বকাপে অবশ্য একটি ম্যাচই খেলতে পেরেছিলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে আবার মুজিব ও নূর খেলেছিলেন একসঙ্গে। মামা-ভাগ্নে সবমিলিয়ে চারটি ওয়ানডেতে একসাথে খেলেছেন।

ভাতিজা ইব্রাহিম ও নূর কখনো একসাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলতে পারেননি। অবশ্য আরেক দিকে থেকে তাদের মিল আছে। ইব্রাহিম বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান। আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম ফিফটি হাঁকানো আফগান হচ্ছেন নূর।

নূর, তার ভাতিজা ইব্রাহিম ও ভাগ্নে মুজিব মিলিয়ে তাদের পরিবার তাই আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ খণ্ড।

Comments

The Daily Star  | English

Climate finance: COP29 draft proposes $250b a year

COP29 draft deal says rich nations should pay the amount to fight climate change

2h ago