শান্ত কি নীরব প্রতিবাদ করলেন?

'আমি একটা বার্তা সবাইকে স্পষ্ট করে দিতে চাই, এটা ব্যক্তিগত কোনো কারণে না, দলের উন্নতির কথা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি। আমি মনে করি তিন সংস্করণে তিন অধিনায়ক থাকা দলের জন্য একটু কঠিন।' শনিবার কলম্বো টেস্টে শ্রীলঙ্কার কাছে ইনিংস ব্যবধানে হারার পর সংবাদ সম্মেলনে এসে টেস্ট অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে এই কথাগুলো বলেন নাজমুল হোসেন শান্ত।
কেউ অসন্তোষ নিয়ে কোন পদ ছেড়ে দিলে বেশিরভাগ সময় 'ব্যক্তিগত কারণ' বলে আলোচনা থামিয়ে রাখতে চান। শান্ত এই চেনা পথে না হেঁটে আলোচনা উল্টো উস্কে দিয়েছেন। শান্ত যেন বুঝিয়ে দিতে চাইলেন বিসিবির নীতিতে আছে গলদ। শান্ত জানিয়ে দিতে চাইলেন নেতৃত্ব দেওয়া, না দেওয়া প্রসঙ্গে বিসিবির নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে ছিলো তার যোগাযোগের ঘাটতি ছিলো, উপযুক্ত আলোচনা ছাড়াই না নেওয়া হয়েছে এসব সিদ্ধান্ত।
নাজমুল হাসান পাপনের আমলেই তিন সংস্করণের নেতৃত্ব পেয়েছিলেন শান্ত। টি-টোয়েন্টি ব্যর্থতায় সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে সরে দাঁড়ান। শ্রীলঙ্কা সফরের আগ পর্যন্ত টেস্ট ও ওয়ানডের নিয়মিত অধিনায়ক ছিলেন। টেস্টে তার মেয়াদ বাড়িয়ে ওয়ানডের ইস্যু ধোঁয়াশায় রাখা হয় সফরে যাওয়ার দুদিন আগ পর্যন্ত।
আমরা একটু ফিরে যাই ১২ জুনে। টেস্ট অধিনায়কত্বর মেয়াদ আরও এক বছর পেয়ে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে আসেন শান্ত। তখনো ওয়ানডে অধিনায়ক ঘোষণা হয়নি। শান্ত তার প্রত্যাশা, পরিকল্পনা জানিয়ে ওয়ানডে নিয়ে আলোচনার অপেক্ষার কথা বলছিলেন। ওয়ানডেতেও যে তিনিই অধিনায়ক থাকছেন এই আভাস তার কাছে তখনো ছিলো। তার কথাবার্তাতেও তেমন ইঙ্গিত মিলছিলো। এমনকি ওয়ানডে দল নিয়ে প্রধান কোচ ফিল সিমন্সের সঙ্গেও বসার কথা ছিলো তার। কিন্তু ওই দিনই নাটকীয়ভাবে সব বদলে যায়। ভার্চ্যুয়াল সভায় মিরাজকে ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে ঠিক করে ফেলা হয়। এবং শান্তর সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে ঘোষণাও দেয়া হয় পরদিন।
শান্ত শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেন তিনি সিরিজের পর সরে দাঁড়াবেন। কলম্বো টেস্টের আগে ক্রিকেট ওয়েবসাইট ক্রিকবাজে সেই খবরও বেরিয়ে আসে। তবে তার প্রতিক্রিয়ায় বিসিবির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল একটি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, শান্তর সঙ্গে একজন বোর্ড পরিচালক আলাপ করেছিলেন সিদ্ধান্তের আগে। শান্ত তা মেনেও নিয়েছেন।
শান্ত অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করে প্রমাণ করলেন তিনি আসলে মেনে নেননি। তিন সংস্করণে তিন অধিনায়ক নীতিতে যেতে হলে যাদের নিয়ে সেই নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে তাদের মতই সবচেয়ে জরুরি। দেখা যাচ্ছে বিসিবির বর্তমান নীতি নির্ধারকরা সেই মৌলিক কাজটাই করেননি। নিজেরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। অথচ বোর্ডের নীতি নির্ধারনী ফোরামে সাবেক অধিনায়ক বুলবুল তো আছেনই, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের দায়িত্বে আছেন দেশের সিনিয়র কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম। বিসিবিতে দায়িত্ব পাওয়ার আগে পর্যন্ত নানান প্রক্রিয়াগত ত্রুটি নিয়ে তারাই সবচেয়ে সরব ছিলেন। একটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দল চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের জোরে চালানো যায় না। সেটা করতে গেলে বুমেরাং হয়, শান্ত সেই প্রমাণ দিয়ে গেলেন। শান্ত যেন নীরবে একটা প্রতিবাদই করতে চাইলেন।
বাংলাদেশকে ১৪ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন শান্ত। তার নেতৃত্বে এসেছে চারটি জয়। জয়ের সাফল্যে তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা টেস্ট অধিনায়ক। তবে একাধিক টেস্টে নেতৃত্ব দেওয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে জয়-পরাজয়ের অনুপাত ও জয়ের শতকরা অনুপাতে শান্তই সফলতম।
টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থা খুব নড়বড়ে। এই অবস্থায় নীতিগত জায়গায় অস্পষ্টতা থাকলে দলটির চলার পথ আরও সংকীর্ণ হতে পারে। বিসিবির বর্তমান নীতি নির্ধারকরা অধিনায়কত্ব নিয়ে পরিকল্পনায় শুরুতেই একটা ধাক্কা খেলেন। এই ধাক্কার পেছনে দায়টাও অন্য কাউকে দেওয়ার অবস্থায় নেই তারা।
টেস্ট মর্যাদাপ্রাপ্তির রজতজয়ন্তী উদযাপন করছে বিসিবি। সেই মর্যাদাপ্রাপ্তির মূল কুশীলবদের অবদান স্বীকার না করে একদিকে পোশাকে উৎসবে তারা যেমন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছেন। একই সঙ্গে টেস্ট দলকে এগিয়ে নেওয়ার পথে যে প্রশাসনিক সহযোগিতা দরকার, মৌলিক সেই জায়গায় করছেন গোঁজামিল। শান্তর নেতৃত্ব ছাড়া তাদের নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করল।
Comments