অতিরিক্ত নির্ভরতাই কমিয়ে দিচ্ছে মোস্তাফিজের কাটারের বিষ?

কার শক্তি কোথায়, দুর্বলতার জায়গা কোনটি- আধুনিক যুগের ক্রিকেটে সব কিছুই খোলা বইয়ের মতো। বোলাররা পারফরম্যান্স অ্যানালিস্টের সহায়তায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্যাটারদের বিশ্লেষণ করে, ব্যাটাররাও তাই। মোস্তাফিজের মুখোমুখি হওয়ার সময় ক্রিজে থাকা ব্যাটারও জানেন, কাটার আসতে পারে!
Mustafizur Rahman

আপনার ধারণা কী, এক ওভারে মোস্তাফিজুর রহমান সর্বোচ্চ কাটার করেছেন কতটি?

টানা ছয় বলে ছয়টাই কাটার ছুড়েছেন বাংলাদেশের তারকা, এমন কিছুর নজির খুঁজে পেতে হলে বেশিদিন পিছিয়ে যেতে হয় না। এই তো চলতি বছরের মার্চেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠের সিরিজের ঘটনা। তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে শেষ ওভার করতে এসে মোস্তাফিজ ছয় বলের ছয়টিই করেছিলেন কাটার।

কার শক্তি কোথায়, দুর্বলতার জায়গা কোনটি- আধুনিক যুগের ক্রিকেটে সব কিছুই খোলা বইয়ের মতো। বোলাররা পারফরম্যান্স অ্যানালিস্টের সহায়তায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্যাটারদের বিশ্লেষণ করে, ব্যাটাররাও তাই। মোস্তাফিজের মুখোমুখি হওয়ার সময় ক্রিজে থাকা ব্যাটারও জানেন, কাটার আসতে পারে! অবশ্য এ নিয়ে গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ার কথা না। মোস্তাফিজের সঙ্গে মাঠে কয়েকবার দেখা হলেই যে কেউ জেনে যাবে, কাটারকে নিজের কত বড় অস্ত্র ভাবেন এই বাঁহাতি পেসার।

মোস্তাফিজ যদি ছয় বল করেন ডেথ ওভারে, তার তিনটি অন্তত কাটার আসবে, এমন কিছু ভেবে থাকলে ব্যাটার অন্তত ভুল কিছু করবেন না। এবারের আইপিএলেই যেমন দেখুন না- চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে মোস্তাফিজ ডেথ ওভারে যা বোলিং করেছেন, তার ৬১ শতাংশ বলই করেছেন স্লোয়ার। যার মানে প্রতি ছয় বলে স্লোয়ারের সংখ্যা গড়ে ৩.৬৬টি। ঘণ্টাপ্রতি ১২৫ কিলোমিটার বা এর চেয়ে কম গতির বলগুলোকে স্লোয়ার ধরে দেখা যাচ্ছে, তিনি সেরকম বল ডেথ ওভারে ছুঁড়েছেন ৬২টি। অপরদিকে ১২৫ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি গতির বেশি অর্থাৎ অন-পেস বল করেছেন মাত্র ৩৯টি।

পাওয়ার প্লেতে গতির ভ্যারিয়েশনে তেমন মনোযোগ থাকে না মোস্তাফিজের। ১৬টি স্লোয়ারের বিপরীতে ৫৯টি গতিশীল বল করেছেন তিনি ইনিংসের প্রথম ছয় ওভারে। ডেথ ওভারে যখনই ব্যাটারের আক্রমণের মুখে পড়েন, তখনই তাকে মূলত দেখা যায় স্লোয়ারে আশ্রয় খুঁজে নিতে। আইপিএল ও তার আগে শ্রীলঙ্কা সিরিজ- সবমিলিয়ে ১২ ম্যাচে কাটার মাস্টার যা বল করেছেন, তার মধ্যে শতকরা ৪২.৯০ ভাগ বলই ছিল স্লোয়ার ধরনের।

স্বভাবতই তাই মোস্তাফিজের সামনে থাকা ব্যাটার প্রস্তুত থাকবেন কাটারের জন্য। চেন্নাইয়ের বিপক্ষে লখনউ সুপার জায়ান্টসের মার্কাস স্টয়নিসের হাঁকানো ওই ছক্কার কথা মনে করে দেখুন। আগের বলে কাটার মিস করেছিলেন স্টয়নিস, পরের বলে আবার এলো কাটার। এবার সামনের পা একটু লেগ সাইডের দিকে সরিয়ে ব্যাকফুটে থেকে লং-অফের ওপর দিয়ে মেরে দিলেন ছক্কা। কিংবা মনে করুন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের রোহিত শর্মার মারা ছক্কা, যেখানে রোহিত আগেভাগেই অফসাইডের দিকে উঠে এসেছিলেন, এরপর মোস্তাফিজের কাটার টেনে মেরে দিয়েছিলেন স্কয়ার লেগ দিয়ে। ২০২৪ আইপিএলে ফিজের ওপর ছক্কার মার পড়েছে ১০টি, তবে তার আটটিই এসেছে ওই স্লোয়ারে! 

মাঝেমধ্যে মোস্তাফিজের কাটার অতটা দুর্বোধ্য মনে না হলেও মোটাদাগে এর ফল যদিও ভিন্ন কথাও বলে। চলতি বছর তার খেলা সব টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তিনি যা কাটার করেছেন স্বীকৃত ব্যাটারদের বিপক্ষে (প্রথম আট ব্যাটার), তাতে প্রতি ছয় বলে গড়ে রান এসেছে ৯.৭৩। আর গতিময় যত বল, সেসবে তার ইকোনমি ৮.৮৭। তবে উইকেট শিকারের পরিসংখ্যান আবার ভিন্ন কথা বলে। যেখানে তার স্লোয়ারের বোলিং গড় ২৪.১৩, সেখানে অন-পেস বলে প্রতি উইকেটে খরচ করতে হয়েছে ৪১.১৭ রান।

শ্রীলঙ্কা সিরিজে তিন ম্যাচেই ওভারপ্রতি দশের ওপর রান দিয়েছিলেন। হতাশাময় সিরিজ বাদে আইপিএলে ঘুরে দাঁড়ান। স্বীকৃত ব্যাটারদের বিপক্ষে পাওয়া ১২ উইকেটের সাতটিই আবার এসেছে স্লোয়ারে। তবে আইপিএলে স্লোয়ারে সাফল্যের পেছনে চেন্নাইয়ের পিচেরও অবদান আছে। ঐতিহাসিকভাবে কিছুটা মন্থর গতির পিচ চেন্নাইয়ের, যদিও মোস্তাফিজের খেলা ম্যাচগুলোতে দুটি বাদে বাকিসব ম্যাচে ব্যাটিং সহায়ক পিচই মনে হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, চেন্নাইয়েই মোস্তাফিজের স্লোয়ারের সাপ ছোবল মেরেছে বেশি। শেষ পাঁচ ওভারে ৩৯টি স্লোয়ার করতে গিয়ে রান দেন মাত্র ৪০। তবে চিপকের স্টেডিয়ামে যেখানে প্রতি ছয়টি স্লোয়ারে রান দিয়েছেন ৬.১৫ করে, অন্যসব ভেন্যুতে তার দ্বিগুণ হারে প্রায়। বাকিসব মাঠে ২৩টি স্লোয়ার করতে গিয়েই রান বিলিয়েছেন ৪৬। চেন্নাইয়ে ৪ উইকেট পেলেও অন্যখানে স্লোয়ারে একটির বেশি উইকেট জোটেনি। 

অন-পেস ডেলিভারিতে চেন্নাইয়ে মোস্তাফিজ ডেথ ওভারে প্রতি ছয় বলে রান দিয়েছেন ১১.০৮, অন্য ভেন্যু মিলিয়ে ১২। এতে কোনো পার্থক্য নেই, তবে চেন্নাইয়ের বাইরের মাঠেও কিন্তু ডেথে মোস্তাফিজের ভরসা সেই স্লোয়ারই ছিল। লখনউ, মুম্বাই, ভাইজাগে মোস্তাফিজ যা বল করেছেন, তার ৬৩.৮৯ ভাগই স্লোয়ার করতে চেয়েছেন। স্লোয়ারে রান তুলনামূলক বেশি খরচ করলেও উইকেট আদায়ে তা সাহায্য করছে। তবে কখনও তো এমনও হয়- যখন বেশি চাপের পরিস্থিতিতে থাকেন মোস্তাফিজ, তখন এই স্লোয়ার ছাড়া আর কোনো পথ যেন খুঁজেই পান না।

এত বেশি স্লোয়ার করে যান মোস্তাফিজ, তবুও সফলতার সূর্য তার গায়ে তাপ দিচ্ছে, সেটা ওই কাটারের ম্যাজিকের কারণেই। তার মতো কব্জির জাদুতে কাটার মারতে পারা লোক যে পৃথিবীতেই নেই! তার কাটারে বাড়তি ঘূর্ণির সাথে অসাধারণ নিয়ন্ত্রণটাও কাজে দেয়। প্রথমবার মুখোমুখি হওয়া ব্যাটারদের তো দুঃসাধ্য মনেই হয়, উঁচুমানের ব্যাটার না হলেও পীড়া দেয় এই কাটার। 

তবে রোহিত, স্টয়নিস, লোকেশ রাহুলদের মতো ব্যাটাররা উল্টো চিত্রও দেখিয়ে দেন মাঝেমধ্যে। অতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে যাচ্ছে না কিনা, সেই প্রশ্নও তখন উঁকি দেয়। স্লোয়ারের ভ্যারিয়েশনগুলো কেন ব্যবহার করেন বোলাররা? ব্যাটারকে চমকে দিতেই তো! অপেক্ষায় আছেন পেসার গতিশীল বল করবেন, হুট করে দেখলেন বল আপনার কাছে আসতে সময় নিচ্ছে। লাইন-লেংথ পড়তে গড়বড় হবে, যুতসই টাইমিং হবে না, এই না হলো স্লোয়ারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বারংবার যখন স্লোয়ার করতে থাকবেন, তখন তো সেই চমকে দেওয়ার উপাদানটা কমে আসে। ব্যাটার আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকবেন, যেমনটা ছিলেন স্টয়নিস কিংবা রোহিত।

অথচ টি-টোয়েন্টিতে কার থেকে কে একধাপ এগিয়ে থাকবে, সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে আজকাল। অনুমেয় না হওয়াটাই বোলারদের মূল চিন্তা হয়ে উঠছে এখন। সেখানে মোস্তাফিজের কাটারে অতিশয় নির্ভরতা তাকে বরং অনুমেয়ই বানিয়ে ফেলে। সন্দেহ নেই, বিশাল অস্ত্র এই কাটার, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে এর বিষও কমে আসতে পারে। মোস্তাফিজ হয়তো অন্য বিকল্পে নির্ভর করতে সেই ভরসা পান না। কাটারে যেভাবে নিখুঁত বোলিং করে যেতে পারেন, ওভাবে ডেথ ওভারে আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প ইয়র্কারে তাকে পারদর্শী দেখা যায় কমই। আইপিএলেই যেমন স্টয়নিসের সামনে শেষ ওভারে ১৭ রান ডিফেন্ড করতে এসেছিলেন, পরে ইয়র্কার বাস্তবায়নে গড়বড় করে প্রথম তিন বলেই দিয়েছিলেন ১৬। 

মোস্তাফিজ তাই ঘুরেফিরে সেই স্লোয়ারের ঘাড়েই মাথা হেলান। কিন্তু এক অস্ত্রেই নির্ভরতা থাকলে আধুনিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছানো কিংবা টিকে থাকা সম্ভব নয়, ভারতের তারকা পেসার জাসপ্রিত বুমরাহর কথায় মনে হয় তাই। এবারের রানবন্যার আইপিএলে বোলারদের ওপর যেখানে বেধড়ক মার পড়ছে, সেখানে একমাত্র বুমরাহই অবিশ্বাস্যভাবে কিপটে বোলিং করে যাচ্ছেন। বুমরাহ এ নিয়ে কদিন আগে বলেছিলেন, 'বোলারদের জন্য এই ফরম্যাট বড্ড নির্দয়। তো আপনার সব ধরনের দক্ষতা থাকা লাগবে। এটার জন্যই আমি অনুশীলন করি। যে কোনো পরিস্থিতি এলে, আমার কাছে বিকল্প থাকা চাই। আমাকে এক উপায়ে নির্ভর হয়ে থাকলে চলবে না। আমাকে শুধুই ইয়র্কারে নির্ভরশীল হলে হবে না, কারণ কিছু দিন থাকবে যেখানে আমার বল জায়গামতো পড়বে না, তখন আমি অন্য ডেলিভারিতে ভরসা করতে পারব। তো এটা নিয়েই আমি আমার ক্যারিয়ারে শুরুতেও কাজ করেছি। প্রত্যেকেই যার যার গবেষণা করছে। ডাটা ও এসব কিছু আসছে, তো লোকেরা তোমার উপর চড়াও হতে বসে থাকবে। তাই আমি চেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতা অর্জন করতে।' 

কোন সময় কোন বিকল্প কাজে লাগাতে হবে, সেটি বুঝতে পারাও গুরুত্বপূর্ণ। শুধু দক্ষতা অর্জনেই মনোযোগ থাকছে না তাই এই বিশ্বসেরা বোলারের, ব্যাটারদের থেকে একধাপ এগিয়ে থাকার চেষ্টাই থাকে বুমরাহর সব সময়, 'আপনার জীবনে খারাপ দিন থাকা চাই তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য। আমি অতীতে যা করেছি তা হচ্ছে- যখনই আমার খারাপ দিন গেছে, পরদিন ঠান্ডা মাথায় আমি ভিডিও দেখেছি। কী কাজ করেনি? আমি কীভাবে খেলছিলাম? তো এসব জিনিস। আপনাকে সময়ের সাথে মানিয়ে চলতে হবে কারণ, এখনকার দিনে আপনি শুধু খেলার দিন এলেন আর বললেন, "আমি এটা করব, হয়তো তা কাজে আসবে," তা হতে পারে না।'

পরিসংখ্যানে তো দেখতেই পেলেন, তবে এ বছর কেন, এমনিতেই মোস্তাফিজের কাটারে নির্ভরতা সেই শুরু থেকেই। নিঃসন্দেহেই তা বড়সড় অস্ত্র, কিন্তু সব ধরনের পিচে কাটার তথা স্লোয়ার কাজে আসে না। তাই সেই অস্ত্রে অধিকতর যে নির্ভরতা, সেটির পরিমাণ কমিয়ে ফেলার সাথে হাতে আরও উপায় থাকাটা নিশ্চিত করে নিতে পারলে- মোস্তাফিজের সে অস্ত্রের কার্যকারিতা বাড়বে তো সন্দেহ নেই, সফলতার সিঁড়ি বেয়ে আরও ওপরে যাওয়াটাও সহজ হবে। বুমরাহও তো সেটাই বললেন নাকি!

(রিফাত বিন জামাল, অতিথি লেখক)

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh China bilateral trade

PM’s visit to China: Dhaka to seek $20b fresh loans from Beijing

Bangladesh will seek fresh loans amounting to $20 billion during Prime Minister Sheikh Hasina’s upcoming visit to China, which Beijing hopes would be a “game changer” in the bilateral relationship.

2h ago