সিলেট থেকে

টেস্ট ক্রিকেটের টানে ইংল্যান্ড থেকে সিলেটের গ্যালারিতে

উত্তর শুনে চমকে যেতেই হলো!

সকাল তখন ১০টার কাছাকাছি। রোদ ঝলমলে দিনে নয়নাভিরাম সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ব্যাট করছে বাংলাদেশ দল। গ্যালারিতে উপস্থিত সব মিলিয়ে প্রায় শখানেক দর্শক। প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ডের গুটিকয়েক সমর্থককেও দেখা যায়। কারও গায়ে নিউজিল্যান্ডের জার্সি, কারও হাতে তাসমান সাগর পাড়ের দেশটির পতাকা।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর মঙ্গলবার এখানে আরেকটি টেস্ট শুরু হলেও দর্শক এত কম থাকার পেছনের কারণ বুঝতে বেগ পেতে হয় না। একে তো সকাল সাড়ে নয়টা থেকে খেলা গড়াচ্ছে, তার ওপর সাপ্তাহিক ছুটির দিনও না। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ আটকে যায় বিদেশি একজনের ওপর। প্রেস বক্স থেকে তাকালে স্কোরবোর্ডের অবস্থান মাঠের ডানদিকে। সেটার ঠিক নিচেই তিনি বসে।

কাছে যেতেই স্পষ্ট হলো তার মুখাবয়ব। বর্ষীয়ান ব্যক্তিটির মাথায় রংচঙে বাকেট হ্যাট, পরনে থাকা ধবধবে সাদা গেঞ্জিতে বেশ কিছু দেশের পতাকার ছবি। তার আশেপাশে জড়ো হয়েছেন কয়েকজন দেশি ক্রিকেটপ্রেমী। তারা সবাই বয়সে তরুণ।

নিউজিল্যান্ডের ভক্ত ভেবে কৌতূহলী হয়ে সেই ভিনদেশির সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে গিয়ে ধরা দিল চমক। তার কণ্ঠে ব্রিটিশ টান খুঁজে পেলেন এই প্রতিবেদক। হ্যাঁ, ব্রিটিশ টান শুনে তো ভুল করা যায় না! চলছে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের টেস্ট। সেখানে তার উপস্থিতি চমক জাগানিয়াই বটে। আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় প্রশ্ন ছোঁড়া হলো, 'এখানে কী করছেন?'

ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের বাসিন্দা স্টিভ নিলের অকপট জবাব, 'আমি টেস্ট ক্রিকেট ভালোবাসি।'

৬৭ বছর বয়সী নিল পেশায় ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। একা মানুষ, এখন অবসরে। তিনি ঘুরে বেড়ান এক দেশ থেকে আরেক দেশে, ক্রিকেটের সবচেয়ে কুলীন সংস্করণ টেস্টের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থেকে। বাংলাদেশে এই নিয়ে এসেছেন তৃতীয়বারের মতো। আগের দুবার যখন এসেছিলেন, তখন তার নিজ দেশের ক্রিকেট দল সফর করেছিল এদেশে। তিনি গিয়েছিলেন ঢাকা আর চট্টগ্রামে। সিলেটে এসেছেন প্রথমবার।

সাদা পোশাক-লাল বলের ক্রিকেটের প্রতি নিলের যে আবেগ, তা নেই অন্য দুই সংস্করণের প্রতি। তার কাছে টেস্টের মাহাত্ম্য ও রোমাঞ্চ অতুলনীয়, 'আমি টেস্ট ভালোবাসি কারণ এটা অনেকটা দাবা খেলার মতো। মাত্র এক সেশনেই সবকিছু বদলে যেতে পারে। আপনি হয়তো জিততে যাচ্ছেন কিন্তু হঠাৎ করেই বোলিং দল আপনাকে আউট করে দিল বা ব্যাটিং দল ঘুরে দাঁড়াল।'

টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে নিলের সন্ধির শুরুটা সেই গত শতকের ষাটের দশকে। তখন তিনি নিতান্তই শিশু। ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ড সফর করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বার্মিংহামের এজবাস্টনে একটি টেস্টে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। ওই ম্যাচ দেখার পর যে প্রেম জন্মায় নিলের, সেটায় আর ভাটা পড়েনি।

সবুজে ঘেরা সিলেট স্টেডিয়াম মনে ধরেছে নিলের। এই ম্যাচে বাংলাদেশ দলকে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি জানান বাংলাদেশি খাবারের প্রতি তার ভালোলাগার কথা, 'আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। বার্মিংহামে আমি বাংলাদেশি খাবারের দোকানে যাই। আর যেসব জায়গায় যাই, সেখানকার লোকেরা সিলেটেরই। তারা বলেছিল যে সিলেট আমার ভালো লাগবে।'

'খুবই সুন্দর মাঠ। ছবির মতো! এখানে আরও বেশি টেস্ট হওয়া উচিত।'

জিম্বাবুয়ে আর আফগানিস্তান বাদে আর সব টেস্ট খেলুড়ে দেশেই ভ্রমণ করেছেন নিল। আফগানিস্তান অবশ্য নিজেদের মাটিতে এখনও কোনো টেস্ট খেলেনি। কয়েক মাস আগেও উপমহাদেশে তিনি এসেছিলেন টেস্টের স্বাদ উপভোগ করতে, 'আমি প্রচুর ঘোরাঘুরি করি টেস্ট দেখার জন্য। এই বছরের শুরুতে পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। সেখানে ইংল্যান্ড খেলছিল। তার আগে নিউজিল্যান্ডকেও পাকিস্তানের মাঠে দেখেছি।'

টেস্টের প্রতি টান থেকে নিল যে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, সেটা যে আর দশটা মানুষের সঙ্গে মেলে না তা তিনি নিজেও অনুভব করেন। শুভকামনা বিনিময় করে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে শোনা হয় সেই গল্প।

নিল বলেন, 'এটা একটা দারুণ ব্যাপার। আমি আবারও সুযোগ পেলে এরকমটাই করব। বিশ্বজুড়ে ঘুরে ঘুরে টেস্ট ক্রিকেট দেখা দুর্দান্ত ব্যাপার। আমি খুবই ভাগ্যবান, খুবই। আমি জানি আরও অনেকে টেস্ট ভালোবাসে কিন্তু তাদের ভ্রমণ করার সেই সুযোগ-সুবিধাটা নেই। আমি একা মানুষ, নিজে নিজে চলি, ভালো একটি পেশাগত জীবন কাটিয়েছি এবং টেস্ট দেখার জন্যই টাকা জমিয়েছি। মানুষ আমাকে পাগল ভাবে!'

Comments

The Daily Star  | English

Jet slams into school, kills 22, mostly children

Toll may rise; around 170 injured, many critically; ISPR says ‘mechanical failure’ caused BAF training plane to plunge into Uttara school

4h ago