এপ্রিলে ভোট হবে?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'এপ্রিল তত্ত্ব' বেশ আলোচিত। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের ৩০ এপ্রিলের ডেটলাইন নিয়ে রাজনীতিতে যে জল ঘোলা হয়েছিল, তারপর থেকে ৩০ এপ্রিলকে অনেকে 'এপ্রিল ফুল' বলে মন্তব্য করেছেন।
পবিত্র ঈদুল আজহার আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১০ মাসে তার নেতৃত্বাধীন সরকারের নানাবিধ কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে সংস্কারের ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশাপাশি এই সময়ের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও প্রত্যাশিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি মোটামুটি চূড়ান্ত সময়সীমার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, 'আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে।'
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এ পর্যন্ত যে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে একটিও এপ্রিল মাসে হয়নি। বরং গত ১২টি নির্বাচনের মধ্যে জানুয়ারিতে দুটি, ফেব্রুয়ারিতে তিনটি, মার্চে দুটি, মে মাসে, জুনে একটি, অক্টোবরে একটি এবং ডিসেম্বরে দুটি নির্বাচন হয়েছে। সুতরাং আগামী নির্বাচন যদি সত্যিই এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেটি এই মাসে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রেকর্ড হবে।
নির্বাচন প্রশ্নে এ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টা যতবার কথা বলেছেন, তার সঙ্গে এবারের ঘোষণার দুটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, তিনি স্পষ্টই বলেছেন, এটা হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে তিনি বারবার বলেছেন 'নির্বাচন'। তাতে অনেকের মনে সংশয় তৈরি হয়েছিল যে, কোন নির্বাচন? এটা কি সংসদ নির্বাচন, গণপরিষদ নির্বাচন, গণভোট বা হ্যাঁ না ভোট নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন? কেননা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণপরিষদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিও রয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জামায়াতের তরফে। কিন্তু এবারের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট করেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছেন।
দ্বিতীয়ত, এতদিন তিনি নির্বাচনের টাইমলাইন বা সময়সীমা বলতে গিয়ে বলেছেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। তার মানে মাঝখানে ছয় মাসের ব্যবধান—যেটি নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর মধ্যে একধরনের দ্বিধা ছিল। কারণ মাঝখানে ছয় মাস সময় রেখে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করাকে কোনো কোনো দল ভোট আরও পিছিয়ে দেওয়ার 'ষড়যন্ত্র' বলে সন্দেহ করেছে। কিন্তু এবারের ভাষণে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তারিখ উল্লেখ না করলেও বলেছেন, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন। প্রথমার্ধ মানে যদি প্রথম সপ্তাহ হয় এবং প্রথম সপ্তাহের দুটি সরকারি সরকারি ছুটির দিন ৩ ও ৪ তারিখও হতে পারে। আবার ৭ তারিখ মঙ্গলবারও হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। বস্তুত এটাই নিয়ম।
আসলেই এপ্রিলের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি না এবং এই ইস্যুতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হবে কি না; ওই সময়ে দেশের পরিস্থিতি কী থাকবে; মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত রোজা হওয়ায় নির্বাচনি প্রচারে সুবিধা-অসুবিধাগুলো কী হবে; এপ্রিলে মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন আছে, তেমনি আছে সাধারণ মানুষের মনেও।
ধরা যাক, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এপ্রিলের প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনটি কেমন হবে; নির্বাচনে কী হবে; সাধারণ মানুষের মনে যে পারসেপশন তৈরি হয়েছে যে, নির্বাচন হলেই বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে—আসলেই সেরকম কিছু ঘটবে নাকি অন্য কিছু হবে?
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান 'আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে' বলে বিভিন্ন সময়ে যে মন্তব্য করেছেন, তার পেছনে কি সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে? বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করবে নাকি একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হবে? বিএনপি এককভাবে সরকার গঠন করে দেশ কি ঠিকমতো চালাতে পারবে? তারা সরকার গঠনের মতো আসন পেলেও কি জাতীয় সরকার গঠন করবে—যেখানে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং অপরাপর গুরুত্পূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ থাকবে? যদি তাই হয়, তাহলে বিরোধী দলে কারা বসবে?
অনেকে মনে করেন, আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারে তাহলে জামায়াত দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হবে। যদি তাই হয়, তাহলে সরকারে বিএনপি এবং বিরোধী দলে জামায়াতে ইসলামী—এরকম একটি ঘটনা ঘটবে? সরকার গঠন করার পরে বিএনপিও কি বিগত সরকাররে মতো কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবে বা উঠতে পারবে? আগামী নির্বাচন কি ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে বা ইনক্লুসিভ নির্বাচন করা যাবে?
তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, গত ১০ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের যে পারফরম্যান্স, দেশের সর্বত্র যে বিশৃঙ্খলা, এখনও বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন গোষ্ঠী যেভাবে মব সৃষ্টি করতে পারছে; সেনাবাহিনী বিচারিক ক্ষমতাসহ মাঠে থাকার পরেও জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা যেহেতু এখনও একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে—ফলে এই সরকার কি শেষ পর্যন্ত একটি অবাধ-সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ-প্রভাবমুক্ত-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে? এরকম অজস্র প্রশ্ন মানুষের মনে আছে—এ কথায় যার কোনো উত্তর নেই।
তাছাড়া অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কোনো আগাম মন্তব্য করা কঠিন। কেননা, শেখ হাসিনার মতো একজন প্রবল ক্ষমতাধর শাসকের যে অভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটবে, সেটি গত বছরের ৫ আগস্ট ভোরেও হয়তো দেশের অধিকাংশ মানুষ ধারণা করেনি। সুতরাং আগামী এপ্রিলেই নির্বাচন হবে কি না বা এপ্রিলের আগে দেশে আরও কী কী ঘটবে—তা এখনই বলা কঠিন।
২.
সাধারণত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয় এপ্রিল মাসে। এটি দেশের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা। ফলে এই পরীক্ষার কেন্দ্র প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে অন্যান্য আয়োজন শুরু হয় আরও অন্তত দুই মাস আগে থেকে। যদি এপ্রিলের প্রথমার্ধেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে ওই মাসে পরীক্ষা গ্রহণ বেশ কঠিন ও ঝক্কির ব্যাপার হবে। কেননা নির্বাচনও একটি বড় পরীক্ষা। মাধ্যমিকে পরীক্ষা দেন শিক্ষার্থীরা, আর নির্বাচনে পরীক্ষা দেন প্রার্থীরা। সেইসঙ্গে এটি নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্র ও স্থানীয় সরকার, আইনশৃঙ্খলা ও সশস্ত্র বাহিনীর জন্যও বিরাট পরীক্ষা। ভোটে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য তো বটেই।
সুতরাং, দুটি বড় পরীক্ষা এক মাসে আয়োজন করা যাবে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। সেক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারি-মার্চে পরীক্ষা নেওয়া যাবে না দুটি কারণে। প্রথমত মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ রোজার মাস। রোজার মাসে এত বড় একটি পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া যৌক্তিক হবে না। দ্বিতীয়ত, ফেব্রুয়ারি-মার্চে পরীক্ষা নিতে গেলে পরীক্ষার্থীরা প্রস্তুতির সময় কম পাবেন। ফলে তারা এটি মানবেন না।
তাহলে কি পরীক্ষা এক মাস পিছিয়ে মে মাসে নেওয়া হবে? সেটা হতে পারে। যাইহোক না কেন, মাধ্যমিক পরীক্ষা ও জাতীয় নির্বাচন একই মাসে তো বটেই, কাছাকাছি সময়েও করা যাবে না। কারণ দুটি আয়োজনেরই প্রস্তুতি ব্যাপক। সেক্ষেত্রে এপ্রিল মাস জাতীয় নির্বাচনের জন্য উপযোগী মাস নয়।
এপ্রিলে মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়ে মে মাসে পরীক্ষা শেষ করার পরে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া যায়। সম্ভবত সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই প্রধান উপদেষ্টা জুন মাসের কথা বলছিলেন। যদি তাই হয়, তাহলে তিনি সেখান থেকে সরে এসে এপ্রিলের কথা কেন বললেন? দুই মাস এগিয়ে এনে তিনি কি দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার দলগুলোকে কিছুটা 'শান্ত' করতে চাইলেন? কিন্তু আখেরে এই কৌশলও সফল হয়নি। কেননা, বিএনপি এরইমধ্যে এপ্রিলে নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে। তারা এখনও আগামী ডিসেম্বরে, এমনকি ডিম্বেরের আগেই নির্বাচন করা সম্ভব এবং উচিত বলে দাবি করছে। তার মানে এপ্রিলে নির্বাচনের যে সময়সীমা প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করলেন, সে বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়নি। হবে কি না তাও নিশ্চিত নয়।
আগামী ১৩ জুন শুক্রবার লন্ডনে সফররত প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। যদি সত্যিই বৈঠকটি হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সেখানে ভোটের সময়সীমা নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হবে। এরপর তারেক রহমান এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিলে বা দলের পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি এলে বোঝা যাবে এপ্রিলের বিষয়ে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না।
৩.
রাজনীতি-সচেতন মহল তো বটেই, সাধারণ মানুষের মনেও এই প্রশ্নটি আছে যে, সরকার যদি এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন করতে পারে, তাহলে ডিসেম্বরে না হোক, অন্তত ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগে করলে কী অসুবিধা? সেক্ষেত্রে ওই সময়ে দেশের আবহাওয়া ভালো থাকবে। মাধ্যমিক পরীক্ষার সঙ্গে সময়ের কোনো সংঘর্ষ হবে না এবং সেনাপ্রধান নির্বাচনের যে সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেছেন, তারও কাছাকাছি থাকবে। অর্থাৎ আগামী অক্টোবর থেকে পরের বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে অসুবিধা কোথায়—এই প্রশ্নের খুব সন্তোষজনক জবাব এখনও বোধ হয় মেলেনি।
সরকার যদি অসমাপ্ত সংস্কারগুলো ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে শেষ করার কথা বলে, অর্থাৎ সংস্কারই যদি নির্বাচন এপ্রিলে নিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হয়, তাহলে এই প্রশ্নও উঠবে বা উঠছে যে, সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গত ১০ মাসে কী কী সংস্কার হয়েছে? দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা কি ২০২৪ সালের আগস্ট-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ভালো আছে? মানুষের মনে স্বস্তি ও নিরাপত্তার বোধ কি আগের চেয়ে বেশি না কম? নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হয় যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয়, সেখানে কি আদৌ কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে? যদি না হয়, তাহলে ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে আর কী কী সংস্কার হবে, যাতে মানুষের জীবনমান উন্নত হবে এবং যে কারণে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনটি করা যাবে না?
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments