বান্দরবান

রাস্তা সম্প্রসারণে কাটা হচ্ছে হাজারের বেশি গাছ

রেইচা হতে গোয়ালিয়াখোলা রাস্তার ধারে ৫শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার
রেইচা হতে গোয়ালিয়াখোলা রাস্তার ধারে ৫শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার

দুই বছর আগেও সড়কটির দুই পাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সমারোহে সবুজ বেষ্টনী মোড়ানো ছিল। কিন্তু রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য এসব গাছ কাটা শুরু হয়েছে।

সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়কটি বান্দরবান সদর উপজেলার বান্দরবান-কেরানীহাট প্রধান সড়ক থেকে শুরু হয়ে রেইচা-গোয়ালিয়াখোলা হয়ে কেয়ামলং ও গুংগুরু সংযোগ সড়কে গিয়ে মিলেছে।

স্থানীয়রা জানায়, সড়ক সম্প্রসারণের কথা বলে সড়কের দুপাশের প্রায় ৫ শতাধিক গাছ ইতোমধ্যে কাটা হয়েছে। কিছু গাছের গুঁড়ি এক্সক্যাভেটর দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে, যেন গাছ কাটার কোনো চিহ্ন পাওয়া না যায়।

তারা বলছেন, গাছগুলোর মধ্যে কোনোটির বয়স ৩০ বছরের কম হবে না।

রেইচা হতে গোয়ালিয়াখোলা রাস্তার ধারে ৫শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার
রেইচা হতে গোয়ালিয়াখোলা রাস্তার ধারে ৫শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার

জানা গেছে, বান্দরবানে গ্রামীণ সড়ক সংস্কার, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের নাম করে এসব গাছ কাটা হচ্ছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কৃষিজমির মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া সড়কের দুপাশে বেষ্টিত বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এর মধ্যে বেশ কিছু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে বলে বোঝা যায়।

সেখানে সড়কের পাশের গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিনিধি।

রাস্তার পাশে পড়ে থাকা গাছ ও গুড়ি। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার
রাস্তার পাশে পড়ে থাকা গাছ ও গুড়ি। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার

তারা জানান, 'আমরা গত চার দিন ধরে গাছ কাটছি। এর মধ্যে ৫৫-৬০টি গাছ কাটা হয়েছে। রাস্তার দুই পাশের সবকয়টি গাছ কাটা হবে।

শ্রমিকরা আরও জানান, দিনের বেলায় গাছের ডালপালা কেটে রাখা হয়। রাতে গাছের গোঁড়া থেকে কেটে ট্রাকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন এক্সক্যাভেটর দিয়ে গাছের গোঁড়া উপড়ে মাটি দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়।

এক্সক্যাভেটর দিয়ে গাছের গুড়ি উপড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার
এক্সক্যাভেটর দিয়ে গাছের গুড়ি উপড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার

তাদের দাবি, গাছ কাটার অনুমতি নিলামের মাধ্যমে পেয়েছেন ঠিকাদার আমানউল্লাহ আমান।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বান্দরবান সদর  ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাবুখয় মারমা ও সদর উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নোমান ২০১৮ সালে গাছগুলো কাটার জন্য নিলামে তোলেন। ওই নিলামে আমি ১০ লাখ টাকায় রাস্তার দুই পাশের মোট এক হাজার গাছ কাটার অনুমতি পাই।'

তিনি আরও বলেন, 'ওই বছরই নিলামের নিয়ম ও শর্ত মেনে টাকা দিয়ে গাছ কাটা শুরু করি। তখন উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ, এলজিইডি ও বন বিভাগ অফিসিয়ালি অনুমতি না থাকার কথা বলে বাধা দেয়। পরে ওই চার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বান্দরবান আদালতে মামলা করি। তার আগে ২৮০টি গাছ কেটেছিলাম। মামলার পর আর কাটতে পারিনি।'

জানতে চাইলে জেলা সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান  সাবু খয় মারমা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে রেইচা-গোয়ালাখোলার সড়ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য বাজেট আসার কথা জানিয়ে  উপজেলা প্রশাসন ও এলজিইডি থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর গত গাছ কাটার নিলামে ডাকা হয়েছিল। নিলাম জিতে আমানউল্লাহ গাছ কাটার অনুমতি পায়।'

এসক্যাভেটর দিয়ে গাছের গুড়ি উপড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার
এসক্যাভেটর দিয়ে গাছের গুড়ি উপড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার

তিনি জানান, ২০১৮ সালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নোমানের সই করা নিলাম ও গাছ কাটার অনুমতিপত্র অনুযায়ী ৬৬৬টি মেহগনি গাছ ও ৩৩৪টি শিশু গাছসহ মোট এক হাজার গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়।

মামলা চলমান অবস্থায় গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে আমানউল্লাহ আমান বলেন, 'আদালতের নির্দেশে গাছ কাটা বন্ধ রেখেছিলাম। সম্প্রতি রাস্তার সম্প্রসারণ কাজের দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদার মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের নির্দেশে আবার গাছ কাটা শুরু করি। গত ১০ দিনে প্রায় ৫০-৬০টি গাছ কেটেছি।'

ঠিকাদার মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাস্তার কাজ করতে গেলে অবশ্যই গাছ কাটতে হবে। এখানে কারও অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।'

সড়কের পাশের গোয়ালিয়া খোলা এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাস্তার পাশের গাছগুলোর বয়স ৭০-৮০ বছরের বেশি হবে। কিছু আছে শতবর্ষী। শিক্ষক হিসেবে বলব, গাছ না কেটে যদি রাস্তা উন্নয়ন, সংস্কার কিংবা সম্প্রসারণ  করা যায় তাহলে আমি এই গাছ না কাটার পক্ষে।'

রাম্তার দুই ধারে সারি সারি সবুজবেষ্টিত গাছের সারি. ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার
রাম্তার দুই ধারে সারি সারি সবুজবেষ্টিত গাছের সারি. ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার

সেখানকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান (৭০) বলেন, 'আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই গ্রামেই। আমার বয়স এখন ৭০ বছর।  ছোটকাল থেকে দেখে আসছি রাস্তার দুই পাশে হাজারের বেশি গাছ। এসব গাছের বয়স আমার বয়সের সমান হবে। কিছু আমার চেয়ে বড়। শুনেছি রাস্তা সংস্কার করবে বলে এই গাছগুলো কেটে ফেলা হবে।

'রাস্তা সংস্কারের নামে প্রতিবার গাছ কাটে। এটা রাতের অন্ধকারে কাঠ-গাছ পাচারের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া ছাড়া স্থানীয় জনসাধারণের কোনো উপকারে আসবে না,' বলেন তিনি।

সদর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান অংসা হ্লা মারমা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাবেক চেয়ারম্যান গাছগুলো কাটার জন্য নিলামে তুলেছিলেন। কিন্তু এই গাছ কাটা নিয়ে মামলা চলমান।'

জানতে চাইলে বান্দরবান সদর বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেইচ্চা-গোয়াখোলা রাস্তাটি স্থানীয় প্রশাসনের অধীন। বন বিভাগ এটার অংশীজন নয়। রাস্তার দুই পাশে গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে আদালতে  মামলা চলমান। সে মামলায় বন বিভাগও  আসামি।'

রাস্তার পাশে পড়ে থাকা গাছ ও গুড়ি। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার
রাস্তার পাশে পড়ে থাকা গাছ ও গুড়ি। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার

'তবে কেউ যদি বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া গাছ পরিবহন করে তাহলে পরিবহন আইন অনুসারে বন বিভাগ ব্যবস্থা নিতে পারে। এর বেশি কিছু করার সুযোগ নেই,' বলেন তিনি।

বান্দরবান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুর রহমান বলেন, 'আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বন বিভাগ গাছ কাটা নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল। এখন আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন, বন বিভাগ তা পালন করবে।'

যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে  সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী পারভেজ সারোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে  বলেন,  'বান্দরবান এলজিইডি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাস্তাটি সম্প্রসারণের প্রকল্প হাতে নেয়। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ এলজিইডি করবে না এবং আমরা কাউকে গাছ কাটা কিংবা পরিবেশ ধ্বংসের জন্য সুপারিশ বা অনুমতি দেই না।'

রাস্তার পাশে পড়ে থাকা গাছ ও গুড়ি। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার
রাস্তার পাশে পড়ে থাকা গাছ ও গুড়ি। ছবি: মংসিংহাই মারমা/স্টার

গাছ কাটা হয়েছে জানালে তিনি বলেন, 'এমন হওয়ার কথা নয়।' এ কথা বলেই তিনি উপসহকারী প্রকৌশলীকে ফোন করে রাস্তা-কালভার্ট নির্মাণে গাছ কাটা বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেন।

Comments

The Daily Star  | English

Tax-free income limit may rise to Tk 3.75 lakh

The government is planning a series of measures in the upcoming national budget to alleviate the tax pressure on individuals and businesses, including raising the tax-free income threshold and relaxing certain compliance requirements.

13h ago