নতুন বছরেও কী থাকবে সামাজিক বৈষম্য

আজ বছরের দ্বিতীয় দিন। গত বছর জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ এক নবধারায় উৎসারিত। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারিত হয়েছে জেনারেশন-জেড-এর সার্বিক  বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এটি সফল হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন নিশ্চিতভাবেই শোভন ও সুন্দর করার প্রত্যয়ে। এ আন্দোলনের প্রেরণা এসেছে ভাষা আন্দোলন ও বিজয়ের মাসকে কেন্দ্র করে। 

ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা এবং অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। স্বাধীনতার পর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছিল-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ওই সংবিধানটি ছিল এক অসাধারণ দলিল। ওই চার মূলনীতি একটি উন্নত, সমৃদ্ধশালী ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশের রূপরেখা নির্দেশ করে। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমরা ওই নীতিমালা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আজও সমাজে বৈষম্য, দারিদ্র্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। জুলাইয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস ভূমিকার কারণে দুইহাজারের অধিক নিরস্ত্র নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন পঞ্চাশ হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা। এক মাসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এতে স্বৈরাচার সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে যদি আমরা একটি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ হবে আরও উজ্জ্বল। ওই স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। যার মাধ্যমে একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। স্বাধীনতা 'অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন'-এ সত্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রেখে দেশের উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়াই হবে প্রকৃত দেশ সংস্কার। এতেই একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। এ ধারায় প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত থাকবে।

বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বিজয়। এ বিজয় বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় গৌরবের। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনামলে বাঙালি রক্ত দিয়েছে। লড়াই করেছে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে। সোয়া ২শ' বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম ও লড়াইয়ে রক্ত দিয়েছে এই বাঙালি জাতি। 

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামো পেয়েছি। যে রাষ্ট্রের ভিত্তি গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য এবং মৌলিক অধিকার চর্চা। বিজয় দিবস মানে বাঙালির মুক্তি, চেতনা ও অজস্র শহীদের রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির এ বিজয়কে ঘিরে আমাদের বুকে জেগে ওঠে নতুন স্বপ্ন, আশা ও বিশ্বাস। বিজয়ের এই ৫৪ বছরে আমাদের নজর দিতে হবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে। যে সামাজিক সংহতির ভাবমূর্তিকে সামনে রেখে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই সংহতিকে সমুন্নত রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। এ ছাড়া প্রশাসনিক ও কর্মক্ষেত্রগুলোকে যথাসম্ভব দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।

চব্বিশের গণঅভ্যত্থান কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিরও প্রতিশ্রুতি প্রসূত। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি সংবিধানের ভিত্তি হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই আদর্শগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় ক্রমেই ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আর্থিক বৈষম্যের শিকার। শহর ও গ্রামের জীবনযাত্রার মানে পার্থক্য বেড়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতান্ত্রিকতা আমাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। দেশের সমৃদ্ধি ও প্রকৃত উন্নয়ন মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত। দেশকে সংস্কার করতে হলে আগে আমাদের সংবিধানের মূলনীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তখনই আমরা সত্যিকার অর্থে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।

বায়ান্ন থেকে চব্বিশ-রক্তবন্যায় বিজয় এসেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ললাটের লিখন বদলায়নি। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রত্যাশা ছিল- এদেশের মানুষ প্রাণ খুলে কথা বলবেন। বাংলার চর্চা হবে রাষ্ট্রের উচ্চাসনে। বাংলাকে অবজ্ঞা করতে পারবে না কেউ। সালাম, জব্বার, রফিকদের সে স্বপ্ন অধরা। বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে একাত্তরে-পরাধীনতা থেকে। ঠাঁই পেয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্রের। রক্তে কেনা স্বাধীনতা। জীবন বিপন্ন করে যাঁরা স্বাধীনতা এনেছেন তাঁরা চেয়েছিলেন সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জিত হবে একদিন।

সেই অঙ্গীকার অঙ্কুরেই বরখেলাপ। রক্তের সাথে বেইমানী প্রতি ছত্রে ছত্রে। ঘুষ, দুর্নীতি, নির্বাচনবিহীন মসনদ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি-সবই বিরুদ্ধে গেছে সাধারণ মানুষের। ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে ও ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার অভিপ্রায়ে। মুক্ত বাংলা পরাধীনতার জালে আবদ্ধ। নেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা, অনুপস্থিত ভোট দেয়ার অধিকার। বিকৃত ইতিহাসের পাতায় একাত্তরের শহীদ ও সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের হাহাকার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। এরপর এলো চব্বিশ। একঝাঁক তরুণের অসম্ভব পদচারণায় মুখরিত বাংলার প্রান্তর। এ যেন আলাদীনের চেরাগ। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। এক আশ্চর্য দুরন্তমনা মন ওদের।

গত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদি কায়দায় ধবংস করা হয়েছে শিক্ষাকে। বাঙালি সংস্কৃতির অপরিহার্য উপাদান শিক্ষা নামক বিষয়টি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেশের প্রকৃত সংস্কার করতে হলে প্রয়োজন শিক্ষার আমূল পরিবর্তন। দেশের শিক্ষাকে যুগোপযুগী ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকার শিক্ষকের বেতন বাড়ানো, শিক্ষার্থীর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়সমূহ সামনে নিয়ে এসেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধিতেও তারা বদ্ধপরিকর।

অন্যায়কে অন্যায়, সত্যকে সত্য বলার দুর্দান্ত সাহস। বৈষম্যহীন সমাজগঠনে বদ্ধপরিকর তারা। স্বৈরশাসকের দাবানলের কাছে কিংবা প্রাণঘাতি বুলেটের কাছে মাথা নোয়াবার নয়। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেশের কাছে, মানুষের কাছে। চেগুয়েরাভারা, মার্টিন লুথার কিং কিংবা মজলুম নেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আদর্শে উজ্জ্বীবিত। জীবন দিতেও কার্পণ্য নেই। দেড় দশকের স্বৈররশাসকের পতন ঘটাতে নির্যাতন, অত্যাচার এমনকি জীবন দিতেও তারা প্রস্তুত। সাইদ, মুগ্ধ, ফারহানের মত তাজা তরুণ প্রাণ ঝরে গেছে। তবুও থামেনি আন্দোলন। পরাজয় হয়েছে ফ্যাসিবাদের। বাংলাদেশ এখন নতুন পথের খোঁজে। কতটা শান্তি পাবে চব্বিশে নিহত দুই হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা। কতটা স্বস্তি পাবে পঞ্চাশ হাজারের বেশি পঙ্গুত্ববরণ করা অসহায়। এ সঙ্গত প্রশ্ন ধুঁকে ধুঁকে উঁকি দিচ্ছে মনের গহীনে। আর কত রক্ত ঝরবে বাংলার প্রান্তরে। কাগজে-কলমেই কি স্বাধীনতা, বিজয় কিংবা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন...?  

সংস্কৃতির সংকট এখনও কাটেনি। ঘোর অমানিশার অশুভ চক্র দানা বাঁধছে চারদিকে। সংস্কৃতির রূপায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো শিক্ষা। দেশে বর্তমানে সংস্কারের কাজ চলছে। পুলিশ সংস্কার কমিশন থেকে শুরু করে নানা ধরনের সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। দেশের টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশে প্রয়োজন শিক্ষা কমিশন গঠন করা। কিন্তু এ বিষয়ক কোনো কমিশন আজ-অবধি গঠিত হয়নি।

গত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদি কায়দায় ধবংস করা হয়েছে শিক্ষাকে। বাঙালি সংস্কৃতির অপরিহার্য উপাদান শিক্ষা নামক বিষয়টি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেশের প্রকৃত সংস্কার করতে হলে প্রয়োজন শিক্ষার আমূল পরিবর্তন। দেশের শিক্ষাকে যুগোপযুগী ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকার শিক্ষকের বেতন বাড়ানো, শিক্ষার্থীর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়সমূহ সামনে নিয়ে এসেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধিতেও তারা বদ্ধপরিকর। তাদের এ কর্মপ্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তন হওয়ার সুয়োগ তৈরি হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজকতা দূর করার জন্য শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে অনেক সময় মাঠে নামতে বাধ্য হয়। ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের এ অসহায়ত্ব চোখে পড়ার মত। অভিভাবকহীন লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে বারবার। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে এসব-শিক্ষার্থীদের অবদান ছিল অসামান্য। তারা চেয়েছিল শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য ও অরাজকতা দূর করতে। কিন্তু বিনিময়ে তারা হয়েছে অভিভাবকহীন শিক্ষাঙ্গনের সারথি।  

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন ব্যক্তি সংস্কৃার। ব্যক্তি উন্নয়ন ও ব্যক্তি সংস্কারের জন্য প্রয়োজন হলো উপযুক্ত শিক্ষা। বাংলাদেশে সুশিক্ষার অভাব বিদ্যমান। শিক্ষায় গলদ থাকার কারণে মানবিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে সংস্কৃতির সংকট দূর করা সম্ভব নয়। 

নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ২০২৪ বিদায়। ফ্যাসিবাদী অপশাসনের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতা আমাদের সামনে হাজির করেছে এক সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। ২০২৫ সালটি তাই আমাদের অগ্রযাত্রার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের বছর। কিন্তু প্রশ্ন জাগে কতটা বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের পথে বাংলাদেশ। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য দূরীকরণে এখনও ফলপ্রসূ কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

গত ১৫ বছরে দুনীর্তির পাহাড় যারা গড়ে তুলেছে তাদেরকে এখনও বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। লুটেরা ও দুর্নীতিবাজরা এখনও সমাজে আধিপত্যবাদী চেতনায় বহাল তবিয়তে আছে। ফ্যাসিবাদী দোসররা এখনও অফিস-আদালতে পূর্বের মতোই আধিপত্যবাদী চেহারায় সমাসীন। এরূপ পরিস্থিতি ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করবে বলে অনেকের ধারণা। পুরাতন বছরের গ্লানি ও ক্লেদ দূর করতে না পারলে নতুন বছরের দিনগুলোও পূর্বের ন্যায় বৈষম্য তৈরি করবে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি না পেলে সংস্কারের কোনো পদক্ষেপই আলোর মুখ দেখবে না। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, 'যার ভিত্তি পচে গেছে তাকে একদম উপড়ে ফেলে নতুন করে ভিত্তি না গাঁথলে তার ওপর ইমারত যতবার খাঁড়া করা যাবে, ততবার তা পড়ে যাবে'। 

Comments