এই যন্ত্রদানব থামাবে কে?

অপঘাত মৃত্যুর উর্বর ভূমি বাংলাদেশ। কত ঠুনকো, কত তুচ্ছ, কত নিষ্ঠুর অবহেলায় এদেশে তরুণ প্রাণ ঝরে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অকারণে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হওয়া মন খারাপ করা এই তালিকার সবশেষ সংযোজন আফসানা করিম রাচি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নবীন শিক্ষার্থীর জীবন ঘড়ি থামিয়ে দিয়েছে এক যন্ত্রদানব। যার হিংস্র গতি থেতলে দিয়েছে রাচির মায়াবী মুখমণ্ডল। স্তব্ধ করে দিয়েছে এক সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণের স্পন্দন।

কেবল মাসখানেক আগে মেয়েটি পা রেখেছিল স্বপ্নের ক্যাম্পাসে। ছায়াঘেরা নতুন এই ভুবনে রাচি হয়তো নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন। হয়তো নতুন ক্লাস, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকদের সান্নিধ্যে নতুন স্বপ্ন বুনছিলেন। হয়তো তার মনে খেলা করছিল ভালোলাগার নতুন রেণু। কিন্তু হায়! একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার আচমকা আঘাতে সব তছনছ। মুহূর্তেই চুরমার জীবন খেলাঘর।

মঙ্গলবার রাতে এই লেখাটি যখন লিখছি, তখনো আমি জানি না এই হতভাগ্য মেয়েটির বাবা-মা কোন অভাগাজন! কী তাদের মনের অবস্থা! আহা, কী দুঃস্বপ্নের রাতই না নেমে এলো তাদের জীবনে। দেশের গণমাধ্যমে লাল কালিতে ব্রেকিং নিউজ চললেও হয়তো মেয়েটির বাবা-মা বিশ্বাস করতে চাইছেন না এটা তাদের আদরের কন্যার মৃত্যু-খবর। অবিশ্বাসী, আতঙ্কিত মন হয়তো বারবার ভাবতে চাইছে, এটা অন্য কেউ! তাদের রাচি নয়। হায়! এই রাতটি যদি তাদের জীবনে স্রেফ একটি দুঃস্বপ্ন হতো।

স্বপ্ন ও বাস্তবতায় অনেক ফারাক। এটাই নিষ্ঠুর সত্য, নিজ ক্যাম্পাসে একটি অটোরিকশা কেড়ে নিয়েছে এক বাবা-মায়ের বেঁচে থাকার অবলম্বন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো জায়গায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো যে একেকটি মৃত্যুদূত হয়ে বিচরণ করে, তা হয়তো এই অভাগা বাবা-মায়ের জানা ছিল না। যদি একটু জানা থাকত, যদি একটু বিপদের গন্ধ পেতেন, তাহলে হয়তো মেয়েটিকে সাবধান করতেন। সতর্ক করতেন। কিন্তু হায়! সেই সময়টুকু হলো না।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ বহু বছর ধরেইে সামনের সারিতে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন সাত হাজার ৯০২ জন মানুষ। যদিও সরকারি সংস্থা বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা কয়েক হাজার কম। যাই হোক, এসব দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতরাও একটি পরিবারের জন্য চিরতরে বোঝা হয়ে যান। যার আর্থিক ক্ষতি অকল্পনীয়।

সড়ক-মহাসড়ক, বিশেষ অঞ্চলসহ ছোট সড়কগুলোতে মৃত্যুর মিছিল চলছে, যার আরেক নিষ্ঠুর উদাহরণ রাচির মৃত্যু। আর এই মৃত্যুর দূত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। যেনতেনভাবে মোটর বসিয়ে একটি রিকশাকে দ্রুতগতির যানে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এটি দেখার জন্য নেই কোনো কর্তৃপক্ষ, নেই চালকের লাইসেন্স। যে যার মতো করে কিছু একটা বানিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছেন। যেখানে চালকের প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর, এক ধরনের বাতুলতা।

রাচির মৃত্যুতে ফুসছে তার বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিবাদ চলছে, স্লোগানে প্রকম্পিত জাহাঙ্গীরনগরের পথ। কিন্তু নির্মম সত্য হলো—কোনো কিছুতেই এই তরুণ প্রাণ আর ফিরবে না। রাচি এরইমধ্যে অচিনপুরে যাত্রা করেছেন প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও। তবে হ্যাঁ, রাচির এই মৃত্যু জাহাঙ্গীরনগরসহ সারাদেশে অটোরিকশা নামক এই যন্ত্রদানবের বিচরণ বন্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করতে পারে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসনসহ অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করতে পারে। তাতে হয়তো ঠেকানো যেতে পারে ভবিষ্যতের করুণ মৃত্যু।

দুনিয়ার কোথাও সড়কে অদক্ষ, অপেশাদার চালক এবং অনিবন্ধিত কোনো যান চলে না। কিন্তু আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাই, বাংলাদেশের রাস্তাগুলো এখন নানা কিছিমের কিম্ভূতকিমাকার নানা যানের দখলে। আরও পরিতাপের বিষয় হলো, এসব দেখার যেন কেউ নেই। সবাই নির্বিকার। মহামান্য, আপনাদের কি ঘুম ভাঙবে? একটা তাজা প্রাণ ঝরে গেছে, যার কয়েকদিন পরেই জাহাঙ্গীরনগরের জলাধারে অতিথি পাখি দেখার কথা ছিল।

কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর ঘাতকের অনিয়ন্ত্রিত গতি মেয়েটিকেই অতিথি বানিয়ে দিলো! হায়!

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh economic growth

GDP growth overstated since 1995

Bangladesh’s economic growth has been overstated since 1995 and the practice of making inflated estimates rose after the fiscal year 2012-13, according to the findings of the white paper panel..It said Bangladesh was seen as one of the fastest-growing economies but its growth became a “par

4h ago