সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি বাস্তবায়নযোগ্য রোডম্যাপ
অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার, যার জন্য নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন প্রয়োজন।
তবে ভোটাধিকার সম্পর্কে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করাও সমানভাবে জরুরি। যদিও নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন যেকোনো সরকার ইচ্ছা করলেই স্বল্প সময়ে করতে পারে, সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার সম্পর্কে মনোভাব পরিবর্তন করা একটি দীর্ঘমেয়াদী কাজ—যার একটি প্রক্রিয়া অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত শুরু করে যেতে পারে।
উভয় লক্ষ্য অর্জনে একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ লেখাটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সংস্কার
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রধান সমস্যা হলো স্বার্থের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব। পাঁচ বছরের মেয়াদে নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনাররা প্রায়ই নিরপেক্ষ সেবা প্রদানের চেয়ে নিজ পদে বহাল থাকার বিষয়েই বেশি মনোযোগ দেন। অন্যদিকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা—যেমন: রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, জেলা নির্বাচন অফিসার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মী—সরকারি কর্মচারী হওয়ায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেও এই স্বার্থের দ্বন্দ্ব বজায় থাকতে পারে। কারণ মাঠপর্যায়ে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা একজন সরকারি কর্মচারী প্রায়ই সম্ভাব্য বিজয়ীদের পূর্বানুমান করতে সক্ষম এবং সে অনুযায়ী আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারেন।
পদের প্রতি লোভ দূর করতে কমিশনারদের স্বল্পমেয়াদী চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যা নির্বাচনের ধরন অনুযায়ী তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারে। নির্বাচন কাজে অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের থেকে কমিশনার নির্বাচন করা যেতে পারে। নির্বাচন সংক্রান্ত যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের একটি পুল তৈরি করা যায়, যারা প্রয়োজন অনুযায়ী মামলার নিষ্পত্তির জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালতও গঠন করতে হবে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজটি দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন। স্বচ্ছতার জন্য এই তালিকা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য একটি অনলাইন ভোটিং সিস্টেম তৈরি করা যেতে পারে, যাতে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি ভোটাররা সহজেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাচনী এলাকার আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা প্রধান কর্মকর্তার জায়গাটি প্রশাসন, সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের দিয়ে সহজেই পূরণ করা যেতে পারে। প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার—যাদের বড় সংখ্যায় প্রয়োজন হয়—বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আসতে পারেন। সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগের প্রয়োজন হলে, নিজ নিজ এলাকার বাইরে নিযুক্ত করতে হবে।
মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ইউনিট সশস্ত্র বাহিনী, বর্ডার গার্ড, রিজার্ভ পুলিশ, আনসার ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠন করা যেতে পারে, যা পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর জুনিয়র কর্মকর্তাদের কমান্ডে পরিচালিত হবে।
জনসম্পৃক্ততা
যদি গ্রামের কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, 'কেন অনেকই এক কাপ চায়ের বিনিময়ে ভোট বিক্রি করে দেয়?' উত্তর হবে, 'মানুষ তাদের নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়েছে। তারা স্বার্থপর এবং দেশ ও সমাজের কল্যাণের প্রতি উদাসীন।' তারা আরও বলতে পারেন, কেবল মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তনই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। তবে, আমি এমন ধারণার সঙ্গে একমত নই। আসল সমস্যা হলো, মানুষ তাদের ভোটের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞ।
ল্যারি ডায়মন্ড তার লেখা 'ডেভেলপিং ডেমোক্রেসি: টুয়ার্ড কনসোলিডেশনে' উল্লেখ করেছেন, একটি টেকসই গণতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য শুধু নির্বাচনী সংস্কারই যথেষ্ট নয়। এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন গুরুত্বপূর্ণ হলেও, ভোট সম্পর্কে জনমতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও সমান গুরুত্ব বহন করে।
জনসাধারণের ভোটের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে ধারণা না থাকায় নির্বাচন সহজেই একদল মানুষের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। অলিগার্করা হলো সমাজের সেই শ্রেণি—যারা সরকার, সমাজ ও অর্থনীতিতে বিপুল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। তারা সাধারণত দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের সম্পদ লুট করে এবং অর্থের বিনিময়ে মিডিয়াকে একচেটিয়া নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা তাদের সঙ্গে সুবিধাজনক মৈত্রী গড়ে তোলে। বিনিময়ে অলিগার্করা প্রতারণা, অর্থ ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচনকে ছিনতাই করে স্বৈরাচারের ক্ষমতা নিশ্চিত করে।
মানুষ সাধারণত নিজের স্বার্থে কাজ করে। যদি প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতো যে সুষ্ঠু ভোট তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্য অপরিহার্য, তাহলে তারা সক্রিয়ভাবে ভোটাধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মাঠ প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, সমবায় ও কৃষি সম্প্রসারণের মতো তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এবং জেলা নির্বাচন অফিসারের সমন্বয়ে ভোটের গুরুত্ব সম্পর্কে গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে।
বড় এনজিওগুলোর কার্যক্রম গ্রামীণ এলাকাতেও বিস্তৃত। তারা স্বাধীনভাবে বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে একই ধরনের কর্মসূচি শুরু করতে পারে। টিকাদান ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানে বিভিন্ন এনজিও উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে। ভোটারদের সচেতন করা তাদের সক্ষমতার মধ্যে পড়ে এবং এটি তাদের সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ বিষয়ে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য দলের সদস্যদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন এমন একটি বিকল্প রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় আশা করছে, যা প্রচলিত রাজনীতির ঊর্ধ্বে সুষ্ঠু রাজনীতি করবে। কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে, ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে যেন তারা দলগত আনুগত্যের পরিবর্তে প্রার্থীর সততা, দক্ষতা ও দেশপ্রেমের ভিত্তিতে ভোট প্রদান করেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিদ্যমান জটিল প্রক্রিয়া, যেমন: এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহ এবং নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পথে বিভিন্ন বাধা দূর করা উচিত। এতে ভোটারদের পছন্দের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনী ব্যবস্থায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া রয়েছে। যেমন: স্বাধীন নির্বাচনী পর্যবেক্ষক, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনী কমিটি এবং নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ। বিভিন্ন এনজিও, নাগরিক সংগঠন ও সিভিল সোসাইটির উদ্যোগে বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রক্রিয়া চালু হতে পারে।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী কমিটি গঠন করে বিভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। যেমন: নির্বাচনী প্রার্থীদের নির্বাচন সংক্রান্ত খরচ অনুসন্ধান করা, নির্বাচন বিধিমালা লঙ্ঘিত হলে তা রিপোর্ট করা এবং ভোটারদের ভোটদানে উৎসাহিত করা। নির্বাচনের দিন ৫০-১০০ জনের স্বেচ্ছাসেবক দল পালাক্রমে ভোটকেন্দ্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষক হিসেবে অবস্থান গ্রহণ করতে পারে এবং প্রয়োজনে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা দিতে পারে।
'সমান্তরাল ভোট গণনা' হলো নির্বাচনের ফলাফল স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করার একটি পদ্ধতি। কেনিয়ায় ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় নাগরিক সংগঠনগুলো প্রশিক্ষিত পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে ভোট গণনা সংগ্রহ করে এবং তা নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করে। যখন নির্বাচন কমিশনের ফলাফলের সঙ্গে সমান্তরাল ভোট গণনায় পার্থক্য দেখা যায়, তখন সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। বাংলাদেশের নাগরিক সংগঠনগুলোও একই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও তার প্রতিকার
আলোচিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনারদের স্বল্পমেয়াদে নিয়োগ দিলে কমিশনের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হতে পারে। এই ঝুঁকি কমানোর একটি উপায় হলো নির্বাচন কমিশনারদের কমিশনের ব্যবস্থাপনা ও লজিস্টিকস সংক্রান্ত সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া। এসব প্রশাসনিক দায়িত্ব পুরোপুরি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ওপর ন্যস্ত করে কমিশনারদের কাজ সীমাবদ্ধ রাখা যেতে পারে শুধুমাত্র নির্বাচন তদারকি, ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশের মধ্যে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো গ্রামীণ ভোটারদের সচেতনতার আওতায় নিয়ে আসা, যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক তথ্য থেকে বঞ্চিত। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে জাতীয় রাজনীতির প্রতি উদাসীনতাও বিদ্যমান। এই বাধা অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজন মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা। যেমন: একজন কৃষি সম্প্রসারণ বা মাইক্রো ক্রেডিট কর্মী মাঠপর্যায়ে করে থাকেন। পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মিডিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারে। কারণ, গ্রামীণ মানুষ এখন স্যাটেলাইট টিভি, এসএমএস ও স্মার্টফোনের মতো প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত।
সমান্তরাল ভোট গণনা পদ্ধতি চালু করার জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও পর্যাপ্ত অর্থায়নের প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধানে নির্বাচনের বহু আগে থেকেই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য দেশের নাগরিক সংগঠন, এনজিও ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া, বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকেও অনুদান চাওয়া যেতে পারে, যারা এই প্রক্রিয়ায় অংশীদার হতে আগ্রহী।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জনসাধারণের ভোটের প্রতি আস্থা তৈরি করা, নির্বাচন প্রক্রিয়াকে অলিগার্কদের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা এবং জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো জরুরি। নির্বাচন কমিশনের উচিত এটা নিয়ে চিন্তা করা যে কীভাবে এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে দেশকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া যায়। জাতীয় নির্বাচন একটি বৃহৎ কার্যক্রম হওয়ায়, জনবল ও অন্যান্য লজিস্টিকের চাপ কমাতে নির্বাচন একদিনে না করে অঞ্চলভিত্তিক কয়েকদিন ধরে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
সাইফুর রহমান: জ্যেষ্ঠ তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সার্টিফাইড প্রফেশনাল অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি
Comments