বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে সুরঞ্জিতের ‘আপত্তি’ এবং এই সময়ের সংবিধান পুনর্লিখন বিতর্ক

'আমাদের সংবিধানে এই বিধানের (মূলনীতি) সংযোজন আইরিশ সংবিধান থেকে ২৩ বছর আগে নেওয়া ভারতীয় সংবিধানের অনুরূপ বিধান দ্বারা অথবা তৎকালীন পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অনুরূপ বিধানের দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়। তবে উপরিল্লিখিত সংবিধানগুলোতে আছে শুধু এ কারণেই আমাদের সংবিধানে বিধানটি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত—এমনটা আমি মনে করি না।'

১৯৭২ সালে গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনায় সংবিধানের চার মূলনীতির সমালোচনা করে মন্তব্যটি করেছিলেন কমিটির কনিষ্ঠ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (মৃত্যু ২০১৭)।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে যে ৩৪ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল, তার ছয়জন সদস্য সংবিধানের বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের যে ভিন্নমতসূচক মন্তব্য বা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন, তার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে তারা কতটা আধুনিক চিন্তার মানুষ ছিলেন।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ৫২ বছর পরে যখন সংবিধান পুনর্লিখন বা বড় আকারে সংশোধনের কথা উঠছে, এমনকি রাষ্ট্রের নানা খাতের মতো সংবিধান সংস্কারের জন্যও কমিশন গঠন করা হয়েছে, তখন অর্ধ-শতাব্দী আগের ওই আলোচনার সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশে সংবিধান নিয়ে আলাপচারিতা ও বিতর্ক মিলিয়ে পাঠ করলে সংবিধানের মূল ত্রুটিগুলো বুঝতে সহজ হবে।

সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের না থাকলেও কমিশন একটি প্রতিবেদন দিতে পারবে, যেখানে সংবিধানের কোথায় কোথায় কী কী সংশোধন বা পরিবর্তন প্রয়োজন তার একটা রূপরেখা থাকে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দল সরকার গঠন করবে, তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই তারা ওই রূপরেখার আলোকে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে পারবে।

তবে যারা সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন বা দাবি তুলছেন, সেটি করতে গেলে গণপরিষদ গঠন করতে হবে। সেই পরিষদে সংবিধান নতুন করে লিখিত হবে। কিন্তু গণপরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন দেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন। কেননা এই সরকারের উপদেষ্টারা বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে শপথ নিয়ে এই সংবিধান সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করেছেন। সে কারণে গণপরিষদ গঠন করে সংবিধান পুনর্লিখন বেশ কঠিন।

দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে সংবিধানকে গণতান্ত্রিক ও গণমুখী করার জন্য একটি প্রস্তাব পেশ—যেখানে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের ঐকমত্য থাকবে। ফলে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, সব দলের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ওই সংশোধনী গৃহীত হবে। অর্থাৎ কোনো দল যদি এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশ আসন না পায়, তাহলে তাকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী অন্যান্য দলের সঙ্গে সমঝোতার মধ্য দিয়ে।

তবে কোন প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধন হবে; পুনর্লিখন হবে কি না অথবা পুনর্লিখন আদৌ সম্ভব কি না—সেই বিতর্কে না গিয়ে বিদ্যমান সংবিধানের কী কী বিচ্যুতি নিয়ে ১৯৭২ সালেই কথা বলেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।

সুরঞ্জিতের আপত্তিগুলো

সংবিধান বিলের ওপর সবচেয়ে বেশি আপত্তি দিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বলা যায় প্রতিটি অনুচ্ছেদ নিয়ে তিনি তার ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। যেমন: রাষ্ট্রের মূলনীতি সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য সমগ্র জনগণই যৌথ মালিকানার মাধ্যমে উৎপাদিত উৎপাদনের প্রকৃত মালিক হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। বলেন, এই উদ্দেশ্যে সম্পদ এবং উৎপাদন পদ্ধতির যৌথ মালিকানা সংবিধানের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত বলে তিনি মত দেন। বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান উদাহরণ হিসেবে আমাদের কাজে লাগতে পারে।

একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের জনপ্রতিনিধিরা সংবিধান রচনা করলেও ওই সময়ই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করে সেগুলো নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তার ভাষায়, 'যে সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না, তার ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং কাজ বর্তমান বিশ্বে স্বীকৃত অধিকার। তাই আমি প্রস্তাব করছি যে, কেবল কৃষক-শ্রমিক নয়, বরং সমগ্র জনগণের জন্য মহান ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে সংবিধানের যে ভাগে মৌলিক অধিকার রয়েছে, সেখানে একটি পৃথক বিধান যুক্ত করে (অর্থনৈতিক) অধিকারগুলোকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে সরকারকে এই দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে।' শিক্ষাকেও তিনি মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।

এই সময়ের বাংলাদেশে পার্বত্য ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা একটি বিরাট ইস্যু। ১৯৭২ সালেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে কেবল নয়, বাংলাদেশে বসবাসকারী সব উপজাতির সার্বিক উন্নতির জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হলেও সেটি নিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের আপত্তি আছে। কেননা তারা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চায়। অতএব এই সময়ের বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ওই আলোচনাটিও বিবেচনার দাবি রাখে।

বর্তমানে জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। শুরুতে এটি ছিল ১৫। ধাপে ধাপে এই সংখ্যাটি বাড়ানো হয়। কিন্তু ১৯৭২ সালেই এই বিধানকে অগণতান্ত্রিক দাবি করে এটি বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি মনে করেন, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিধান জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারকে নিশ্চিত করে না, বরং এর মাধ্যমে অন্যদের ওপর নারীদের নির্ভরশীল করে তোলা হয়। সে কারণে তিনি এই বিধান বাতিল করে 'জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান'—এরকম বিধান করার প্রস্তাব করেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে এখনও যেসব আলোচনা ও বিতর্ক হয়, সেটি ১৯৭২ সালেই হয়েছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এই পদগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হলে প্রার্থীদের কমপক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের বিচারপতি হতে হবে। কারণ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের পদ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তাদের নিরপেক্ষতার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে গণতন্ত্রের কাঠামো, অর্থাৎ রাষ্ট্রের মূলনীতি। সে কারণে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে থাকা বিচার বিভাগ থেকে নিয়োগ করে এসব পদ পূরণ করা একান্ত কাম্য।

আরও যারা আপত্তি দিয়েছিলেন

প্রসঙ্গত, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়া আরও যে পাঁচ সদস্য সংবিধান বিলের ওপর আপত্তি দিয়েছিলেন। তারা হলেন হাফেজ হাবীবুর রহমান, আসাদুজ্জামান খান, এ কে মুশাররফ হোসেন আকন্দ, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী এবং ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল।

এই সময়ের বাংলাদেশে সংবিধানের যেসব অনুচ্ছেদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক ও সমালোচনা হয়, তার অন্যতম সংসদ সদস্যদের পদ বাতিলসম্পর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ। বলা হয়, এই অনুচ্ছেদের ভয়ে সংসদ সদস্যরা নিজেদের দল তো দূরে থাক, কোনো বিল পাশের সময়ও দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন না। অর্থাৎ এটি এমন এক বিধান যা সংসদ সদস্যদের বাকস্বাধীনতা হরণ করে এবং সংসদকে সংসদ নেতার ওপর নির্ভরশীল একটি একনায়কতান্ত্রিক প্লাটফর্মে পরিণত করে।

বস্তুত ১৯৭২ সালে গণপরিষদেই এই বিতর্ক উঠেছিল যে এরকম একটি বিধান আদৌ সংবিধান রাখা উচিত কি না, যা কার্যত সংসদ সদস্যদের ভয়ের মধ্যে রাখে?

দলে শৃঙ্খলা রক্ষা তথা ফ্লোর ক্রসিং ঠেকাতে এই বিধান যুক্ত করা হলেও হাফেজ হাবীবুর রহমান এই বিধানটি বাতিলের প্রস্তাব করে বলেন, গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোথাও কোনো রাজনৈতিক দল থেকে বহিষ্কারের কারণে সংসদের সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায় না। সংসদ সদস্য পদের এই ধরনের অবসান কেবল একটি স্বৈরাচারী শাসনে পাওয়া যায়, যেখানে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বিরাজ করে। একজন সংসদ সদস্য ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হন, দলের সদস্যদের দ্বারা নন। একবার তিনি নির্বাচিত হলে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য হন এবং তখন তিনি কেবল তার রাজনৈতিক দলের সদস্য থাকেন না। সদস্য পদ বাতিলের এ ধরনের ব্যবস্থার ফলে দলীয় একনায়কত্ব এবং দলের নেতার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা পায়।

হাফেজ হাবীবুর রহমানের মতে, কোনো দলের কখনোই জনগণের রায় অর্থাৎ নির্বাচন বাতিল করার অধিকার থাকতে পারে না। দলের নেতারা যেখানে তাদের রাজনৈতিক আচরণের জন্য ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ নন, সেখানে একজন সংসদ সদস্য তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।

দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কার্যকরী সদস্যকে নিয়ন্ত্রণমূলক শাস্তি প্রদানের বিধানের প্রয়োজন হয় তাহলে ভোটারদের মাধ্যমে তা করার (রিকল) ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই দল কর্তৃক বহিষ্কারের ভিত্তিতে সদস্যপদ বাতিলের মতো জঘন্য ব্যবস্থা থাকতে পারে না। এ ধরনের ব্যবস্থা বহাল থাকলে দলীয়ভাবে হেনস্তার শিকার হওয়ার ভয়ে সদস্যরা সংসদীয় দলের বৈঠকেও দলের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাবেন না।

অধিকন্তু, আমাদের দেশে সংসদীয় নেতা ও দলীয় নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম, রীতি বা প্রথা গড়ে ওঠেনি। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে একজন দলীয় নেতা ও সংসদীয় নেতা আধিপত্য বিস্তারের জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের বা সমর্থকদের দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে অথবা শুধু প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এবং সেখানে দলীয় নেতার প্রিয়ভাজনকে স্থলাভিষিক্ত করতে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হতে পারে। সুতরাং দল কর্তৃক বহিষ্কারের কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিলের এমন একটি ঘৃণ্য বিধান একটি দলের মধ্যেও অনেক দ্বন্দ্ব ও অচলাবস্থার জন্ম দেবে। দলীয় শৃঙ্খলা এবং নির্বাচনী এলাকা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা সব সময় একই নয় এবং কখনো কখনো তা সাংঘর্ষিক হতে পারে।

এই সময়ের বাংলাদেশে অনেকেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় বলেছেন, তার দল ক্ষমতায় এলে তারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গড়ে তুলবেন। বস্তুত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের আলোচনা ১৯৭২ সালে গণপরিষদেই তুলেছেন কমিটির সদস্য হাফেজ হাবীবুর রহমান।

ক্ষমতার ভারসাম্য

প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতাবান করার বিরুদ্ধেও গণপরিষদ সদস্যদের অনেকে বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু তার জবাবে কমিটির কোনো কোনো সদস্য বলেছেন, কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্র চাইলে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাবান করতে হবে। কিন্তু গত ৫৩ বছরের বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক সংকট হয়েছে তার পেছনে যে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা তথা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা বড় অংশে দায়ী—সে বিষয়ে সম্ভবত এখন আর কেউ দ্বিমত করবেন না। সে কারণে এখন যারা সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধনের পক্ষে, তাদের সবাই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলছেন। শুধু তাই নয়, একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হওয়ার পথও সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করা উচিত বলে তারা মনে করেন।

বলাই হয়, বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে রাষ্ট্র ক্ষমতার ভারসাম্য। অর্থাৎ এখানে প্রধানমন্ত্রীকে এককভাবে এতটাই ক্ষমতাবান করা হয়েছে যে, তিনি চাইলে যা খুশি করতে পারেন এবং তার এই সাংবিধানিক ক্ষমতাই তাকে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরাচারে পরিণত হওয়ার সহায়ক। সে কারণে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না; রাষ্ট্রপতি নির্দলীয় হবেন—এরকম অনেক বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব আছে।

সুন্দর সংবিধানই শেষ কথা নয়

একুশে শতকের উপযোগী একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য একটি সুন্দর সংবিধান যেমন প্রয়োজন, তেমনি সংবিধানে অনেক সুন্দর কথা থাকলেই সেই দেশটি ‍সুন্দর হয়ে উঠবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেননা, সংবিধানের বিধানের আলোকে অন্যান্য আইন কাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না হলে শুধু সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনর্লিখনের মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশে গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

যারা রাষ্ট্র সংস্কার করবেন এবং সেই সংস্কারের আলোকে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, কাজের প্রতি আন্তরিকতা এবং দেশপ্রেমের ওপরেই মূলত নির্ভর করে দেশ কোনদিকে যাবে। অর্থাৎ দেশ একটা অন্ধকার থেকে আরেকটা অন্ধকারে যাত্রা করবে কি না—তার অনেকখানি নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং যারা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের ওপর।

সংবিধান সংশোধন জরুরি বিষয়, এটা যেমন ঠিক, তেমনি এরচেয়ে আরও অনেক জরুরি বিষয় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে কাজ করতে হবে। বাজার অর্থনীতি ঠিক রাখা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো, প্রতিহিংসা প্রতিহত করা এবং মানুষের বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মতো কাজগুলো খুব সতর্কভাবে করতে হবে। না হলে তাদের সংস্কার উদ্যোগগুলো মুখথুবড়ে পড়বে—যা দেশকে আরেকটি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। মোদ্দা কথা, এই সরকারের সফলতার ওপর অনেকখানিক নির্ভর করছে আগামীর বাংলাদেশ।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

9h ago