জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাত: ভোক্তার ঘাড়ে ভূতের আছর...
বহুদিন পর বিগত সরকারের সময়ে ২০২২ সালে মালয়েশিয়াতে সরকার টু সরকার চুক্তি হলো শ্রমিক পাঠানোর। সেই চুক্তির অধীনে সে দেশে শ্রমিক পাঠাবে বাংলাদেশ সরকার। সরকারি এই চুক্তির সুবিধা হলো, খরচ কম পড়বে। চুক্তি হওয়ার পর বলা হলো, মালয়েশিয়াতে শ্রমিক পাঠাতে খরচ পড়বে জনপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। লাখো শ্রমিকের কম খরচে বিদেশে কর্মসংস্থানের এই সুযোগ জনমনে আশা জাগালেও শেষে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠল।
দেড় বছরে মালয়েশিয়াতে গেল প্রায় সাড়ে চার লাখ শ্রমিক। সবাই যে কাজ পেল তাও না। অনেকেই দুর্দশায় পড়ল। অনেকেই টাকা দিয়েও যেতে পারল না। তারচেয়েও বড় কথা জনপ্রতি শ্রমিককে দিতে হলো পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। সরকারঘনিষ্ঠ চারজন সংসদ সদস্য সিন্ডিকেট বানিয়ে এই বাড়তি টাকা লুট করল। রাষ্ট্রীয় সহায়তায় এই লুণ্ঠনের ফলে চারজন এমপির রিক্রুটিং এজেন্সি সাধারণ মানুষের পকেট থেকে অন্যায্যভাবে বাগিয়ে নিল অতিরিক্ত প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকার নির্ধারিত রেটের চেয়ে জনপ্রতি চার লাখ ৬৫ হাজার টাকা করে বেশি নিয়ে লুণ্ঠনমূলক মুনাফাকারী তার ভাগ খোদ শেখ হাসিনাকেই দিয়েছিল বলে এখন মিডিয়ায় খবর বেরোচ্ছে।
এই যে জনগণকে, ভোক্তাকে লুণ্ঠন করে ব্যবসা করা, মুনাফা করা, ভোক্তার ব্যয় বাড়িয়ে দেওয়া—এটা আমাদের রাষ্ট্রের সর্বত্রই রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এই লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বা লুণ্ঠনমূলক মুনাফার উপস্থিতি এখন সর্বত্র।
২.
হালে হাতে আসা বিদ্যুৎখাতের কিছু তথ্যে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র চুক্তি করে, কাগজে লিখে এমন সব ফাঁকফোকর তৈরি করেছে যা ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা ভোক্তাকে যাচ্ছেতাইভাবে লুণ্ঠন করে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার আমলে বিদ্যুৎখাতের উন্নয়নের দর্শনই ছিল, এই খাত যাতে রাজনৈতিক অর্থায়নের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ফলে তারা দায়মুক্তির আইন বানিয়েই ব্যবসা করতে দিয়েছে অলিগার্ক গোষ্ঠীকে। এই গোষ্ঠীতন্ত্র সরকারি আইনের সুবিধা তো নিয়েছেই, চুক্তিতে এমন সব শর্ত রেখেছে যেটা দিয়ে লুণ্ঠনমূলক ব্যবসা চালিয়ে গোচরে ও অগোচরে ভোক্তার ওপর লুণ্ঠনমূলক ব্যয় চাপিয়ে মুনাফা করেছে দেদারসে।
একটা উদাহরণ দিই। বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি বা আইপিপিগুলোর চুক্তিতে হিট রেট বলে একটা বিষয় উল্লেখ থাকে। হিট রেট হচ্ছে বৈদ্যুতিক পাওয়ার প্ল্যান্টের দক্ষতার একটি পরিমাপ, যা একটি জ্বালানিকে তাপে এবং বিদ্যুতে রূপান্তর করে। অর্থাৎ এক ইউনিট বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্ন করতে প্রয়োজনীয় জ্বালানির পরিমাণ প্রতিফলিত করে হিট রেট, যার একক কিলোজুল বা কিলোওয়াটআওয়ার।
হিট রেট বলে যে কর্মদক্ষতার কথা উল্লেখ করা থাকে চুক্তিতে, বাস্তবে তার থেকে কম কর্মদক্ষতা নিয়েই চলে এসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এখান থেকে প্রতারণার মাধ্যমে এই বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো অধিক অর্থ আদায় করে। যেটা শেষমেশ ভোক্তাদের ঘাড়েই চাপে। যেমন: শাহাজীবাজার পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের মালিকানাধীন শাহজীবাজার ৮৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের (গ্যাসচালিত) চুক্তিতে ইঞ্জিনের হিটরেট ১৩ হাজার ২০০ কিলোজুল বা কিলোওয়াটআওয়ার থাকার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইঞ্জিনের হিটরেট থাকে নয় হাজার ৯০০ থেকে ১০ হাজার ১০০ কিলোজুল বা কিলোওয়াটআওয়ার।
ফলে, চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সালের আগস্টে শাহাজীবাজার ৮৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের বিল বাবদ পাওনা হয় ২৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কিন্তু ওই মাসে শাহাজীবাজার বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহকারী জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির প্রকৃত বিল আসে ২৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা। যেহেতু প্রকৃত বিলের কাগজ দাখিল করতে হয় না, চুক্তিতে থাকা হিট রেটের শর্তেই বিল পরিশোধ করতে হয়, তাই শাহাজীবাজার পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড মুফতে পেয়ে যায় অতিরিক্ত ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এই টাকা যুক্ত হয় এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচে। এভাবেই অলিগার্কদের লুণ্ঠনমূলক মুনাফার শিকার হয়ে এই টাকা পরিশোধ করে ভোক্তারাই।
৩.
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি তেল লাগে। সেই তেলের একটা হচ্ছে ফার্নেস ওয়েল। এটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সেটার জন্য জাহাজ ভাড়া লাগে। আগে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) নামের সরকারি সংস্থা ফার্নেস ওয়েল এনে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সরবরাহ করত। পরে একসময় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র নিজেরাই এই তেল আমদানির সুযোগ পায়। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তেল আমদানির যে জাহাজ ভাড়া, সেটা আবার পরিশোধ করে পিডিবি বা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো)। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রতি ক্ষেত্রে ফার্নেস অয়েলের মূল্য নির্ধারণের সময় ক্রয়মূল্য, জাহাজ ভাড়া, বিমা, করসহ বন্দরের যাবতীয় খরচ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্টোরে পৌঁছানো পর্যন্ত পরিবহন ভাড়া বিবেচনা করা হয়।
বিউবো যেহেতু ভাড়া পরিশোধ করেছে সেহেতু বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো ৩০ হাজার মেট্রিকটন ধারণক্ষমতার জাহাজে মাত্র ১৫ হাজার মেট্রিক টন আমদানি করেছে। ফলে সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রতি মেট্রিক টন জাহাজ ভাড়া পড়েছে ৪০ থেকে ৬০ মার্কিন ডলার পড়েছে। অপর দিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে পায়রা পর্যন্ত কয়লা আমদানিতে জাহাজ ভাড়া পড়েছে প্রতি মেট্রিক টনে ১৫ থেকে ২৫ মার্কিন ডলার। এটা ব্যয়বহুল ভাড়া। কেননা, ফার্নেস অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে জাহাজে ক্ষমতার ন্যূনতম ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আমদানি করতে হবে—এমন শর্ত থাকলে অথবা কেন্দ্রীয়ভাবে বিপিসির মাধ্যমে আমদানি করা হলে এসব লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফার সুযোগ কমে আসত।
৪.
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে জ্বালানি আমদানির নামে সব খরচ যোগ করার পর ফার্নেস অয়েলের মোট মূল্যের ওপর নয় শতাংশ সার্ভিস চার্জ দেওয়া হয়। বর্তমানে ফার্নেস অয়েলের মূল্য বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় নয় শতাংশ সার্ভিস চাজ হিসেবে বিউবোর বছরে প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে বিপিসির দক্ষ ক্রয়ের মাধ্যমে মাধ্যমে ফার্নেস ওয়েল আমদানি করা হলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে এবং লুণ্ঠনমূলক মুনাফা হিসেবে নয় শতাংশ সার্ভিস চার্জ পরিশোধের প্রয়োজন হবে না। অথচ, চুক্তিতে এরকম ভোক্তাস্বার্থবিরোধী শর্ত রেখে লুণ্ঠনমূলক মুনাফা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
বিপিসি তরল জ্বালানি ক্রয় করে ভরে (মাস), বিক্রি করে আয়তনে (ভলিউম)। তাতে তার সিস্টেম গেইন হয়। এমন অবৈধ সুযোগ না থাকলে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে সাশ্রয় হতো প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটাও ভোক্তার ব্যয় কমাত।
ব্যক্তি মালিকানাধীন ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ৪০টি। ক্যাপাসিটি চার্জ প্রতি মেগাওয়াটে গড়ে ১২ ডলার। চুক্তি মতে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ১০ শতাংশের বেশি সময় আউটেজে বা উৎপাদনের বাইরে থাকতে পারবে না। অথচ অধিকাংশ সময়ে এরা উৎপাদনে থাকে না। ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই পায়। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২২ মাস ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ তারা নিয়েছে ১৩ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের সময় বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এই লুণ্ঠনমূলক মুনাফা যুক্ত হয়েছে। ভোক্তাদের এই খরচ বহন করতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা অলিগার্কের সহযোগীর ভূমিকায় না থাকলে এক্ষেত্রে সাশ্রয় হতো ১৩ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।
৫.
ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর গ্যাস, কয়লা ও বিদ্যুতের আমদানি বাড়াতে অধিকতর গুরুত্ব দেয়। প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগের মাধ্যমে সরকার তৈরি করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অজুহাত। যার ফলাফল এই খাতে লুণ্ঠন প্রতিষ্ঠা। তৈরি হয় দায়মুক্তির বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০। এই আইনের মেয়াদ বাড়তেই থাকে। এই আইনের আওতায় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু সংখ্যক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তৈরি করে একচ্ছত্র আধিপত্য। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্টি হয় একটি অলিগার্ক গোষ্ঠী।
২০০৯ সালে বিগত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুৎ সংকট প্রকট থাকলেও তখন জ্বালানি বা আর্থিক ঘাটতির কথা শোনা যায়নি। যদিও উৎপাদনক্ষমতার স্বল্পতার কারণে তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু বিগত সরকার পতনের সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রবল সংকট দৃশ্যমান হয়েছে। রয়েছে চরম আর্থিক ঘাটতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অসহনীয় মূল্যস্ফীতি রেখে গেছে শেখ হাসিনার সরকার। কম-বেশি ১০ শতাংশ বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে ছয় শতাংশের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে তাই একদিকে যেমন রয়েছে আর্থিক সংকট, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে ন্যূনতম ব্যয়ে মানসম্মতভাবে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ।
৬.
ভোক্তার জন্য লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফার এই চক্র দেশের সব খাতেই সক্রিয় রয়ে গেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এর প্রাবল্য এবং উপস্থিতি সবলভাবেই দৃশ্যমান। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত যেহেতু অর্থনীতির প্রাণভোমরা এবং জনস্বস্তি বা জনদুর্ভোগের প্রধানতম দৃশ্যমান খাত—তাই এই খাতে নতুন সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। দায়মুক্তির আইন স্থগিতসহ জনস্বার্থবিরোধী বিইআরসি আইনের ধারা ৩৪ক বাতিল হয়েছে। তারপরও সরকারের জন্য এই খাতে রয়েছে বিশেষ চ্যালেঞ্জ।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভোক্তাস্বার্থ লুণ্ঠনকারী বিগত সরকারের অলিগার্ক গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রধানতম দোসর আমলাতন্ত্র এখনো স্বপদে বহাল। তারাই এই খাতে সংস্কারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যাদের হাতে পরিচালিত হয়েছে এই খাতের দুর্নীতি-লুণ্ঠনের দুষ্টচক্র, সেসব আমলারাই এখনো চালকের ভূমিকায় বহাল আছেন। যাদের হাত ভোক্তাদের লুণ্ঠনে রঞ্জিত, তারাই এই খাতের নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে আছেন। জ্বালানি অপরাধের অভিযোগে যাদের বিচার হওয়ার কথা, তারাই এই খাতের কর্তা হিসেবে সক্রিয় আছেন। তারাই সংস্কারের নিমিত্তে এই খাতের নানান কমিটিতে এমন সব লোকদের যুক্ত করছেন, যারা অতীতে জনস্বার্থের বিপরীতে বিদেশি তেল-গ্যাস-কোম্পানিসহ দেশীয় অলিগার্কদের স্বার্থ দেখেছেন। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির অবসান দরকার। ভোক্তাবান্ধব বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত রূপান্তরের চলমান প্রক্রিয়ায় তাই এখন দরকার নিরপেক্ষ স্বাধীন জ্বালানি সংস্কার কমিশন। অন্তত সেই কমিশনের হাত ধরে যদি এই খাতে ভোক্তার ওপর ভূতের আছর কিছুটা কমানো যায়, সেটা নজির হয়ে অন্য খাতেও ভোক্তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করবে।
শুভ কিবরিয়া: সাংবাদিক ও প্রকৌশলী
Comments