সিএসএ বাতিল ও অধ্যাদেশ প্রণয়ন প্রসঙ্গে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে ১ জুলাই থেকে তাৎপর্যপূর্ণ শিরোনামে আন্দোলন চলেছে। অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) এক গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে জুলাই বিপ্লব সফল হয়েছে। গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে দুজন ইয়াং স্টার মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
স্বল্প সংখ্যক পত্রিকা সাবেক সরকারের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে এই জুলাই বিপ্লবের প্রকৃত তথ্য ও চিত্র বাংলাদেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে পৌঁছে দিতে পেরেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা সেখানে মূলত তথৈবচ। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার শীতঘুমে চলে যাওয়ার প্রধান কারণ সাবেক সরকার প্রণীত ডিজিটাল ও সাইবার নিরাপত্তা আইন।
সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে। সাংবাদিকরা হুইসেল ব্লোয়ারের কাজটি করে থাকেন। আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রবাদ পুরুষ ও প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন বলেছিলেন, 'আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে, তুমি কী সংবাদপত্র বিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটি বেছে নেবো।'
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পরে শাসকগোষ্ঠী বারবার তা নিজেদের স্বার্থে কাঁটাছেড়া করার পরেও সেখানে কিছু সংখ্যক অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে। অথচ পরবর্তীতে প্রণীত আইনগুলো সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সরকার ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের আইন; ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেরেসি আইন এবং ১৯৭৪ সালে প্রণীত বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ অন্যান্য আইন নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহার করেছে।
তথ্য প্রযুক্তির বিস্ফোরণের যুগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণীত হবে, সেটিই স্বাভাবিক। ২০০৬ সালে প্রণীত আইসিটি অ্যাক্টের সেকশন ৫৭-এর দুটি উপধারা বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। ৫৭ ধারাটি মূলত ২০০৬ সালের ৩৯ নম্বর আইনের ধারা। মূলধারায় বলা হয়, 'ইলেকট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানির তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড'।
৫৭ ধারার উদ্বেগের বিষয়গুলো হলো—
১. পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে কাউকে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেপ্তার করতে পারবে এবং সেটি জামিন অযোগ্য হবে।
২. অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড।
ভারতে ৫৭ ধারার অনুরূপ একটি ধারা ৬৬এ ছিল। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল ঘোষণা করে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ৫৭ ধারা চ্যালেঞ্জ করা একটি রিট হাইকোর্ট খারিজ করে দেয়। আবেদনটি করেছিলেন জাকির হোসেন এবং এর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিকী ও শিশির মনির।
রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা প্রশাসনকে অগাধ ক্ষমতা অর্পণ করেছে, যা সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২ ও ৩৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৫৭ ধারাটির ভয়ংকর, ব্যাপক ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।
তা সত্ত্বেও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সরকার সাংবাদিক নেতা, মানবাধিকার সংস্থা ও সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনের মতামত উপেক্ষা করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রণয়ন করে। এই আইনের খসড়া প্রস্তুত এবং প্রণয়নের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল বেসামরিক আমলাদের হাতে—যারা মূলত চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণে প্রশিক্ষিত ছিল।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫৭ ধারাটিকে আরও ভয়ানক ও বিস্তৃত পরিসরে নানা ধারায় বিন্যস্ত করা হয়। এই আইনের অধীনে সাংবাদিকরা ব্যাপকভাবে হুমকি, হয়রানি, গ্রেপ্তার, কারাঅন্তরীণ ও নিখোঁজ হন। ২০২০ সালে ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ৫৩ দিন নিখোঁজ ছিলেন। এরপরও তাকে সাত মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে ২০২০ সালে গ্রেপ্তার করার পর নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। কার্টুনিস্ট কিশোর একটি কার্টুন এঁকেছিলেন। লেখক মুশতাক আহমেদ তাতে ক্যাপশন লিখেছিলেন। গ্রেপ্তারের ১০ মাস পরে ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি কাশিমপুর কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।
দেশে ও বহির্বিশ্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে (ডিএসএ) বলা হতো 'ড্রাকোনিয়ন অ্যাক্ট'। ২০২৩ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক সরকারের প্রতি ডিএসএ প্রয়োগ স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০২২ সালে তার দপ্তর ডিএসএ পর্যালোচনা করে আইনটির ২১ ও ২৮ ধারা বাতিল এবং আটটি ধারা সংশোধনের সুপারিশ করেছিল।
ডিএসএ সংস্কারের নামে দুঃস্বপ্নের পুনরুত্থান ঘটে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে পুরনো ধারাগুলোর বিন্যাস-সমাবেশে সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (সিএসএ) ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়। ডিএসএতে যেখানে ২০টি শাস্তিযোগ্য ধারার ১৪টি ছিল জামিন অযোগ্য, সেখানে সিএসএতে অজামিনযোগ্য ধারার সংখ্যা চারটি—১৭, ১৯, ২৭ ও ৩২। কারাদণ্ডের মেয়াদ কমানো হয়েছে, তবে জরিমানার পরিমাণ এত বেশি যে সেটি গণমাধ্যম ও সাংবাদিক কারো পক্ষেই পরিশোধ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে মানহানির মতো অপরাধের ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের পরিবর্তে জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এই আইনে অপরাধের সংজ্ঞায়ন এতো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত এবং অস্পষ্ট যে, তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও কর্তৃপক্ষকে বিশাল ক্ষমতার আধার করেছে এবং তারা সানন্দে এই আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ 'আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ'র (আইসিসিপিআর) স্বাক্ষরদাতা হিসেবে এর অঙ্গীকার লঙ্ঘন করতে পারে না। এই সনদ প্রতিটি ব্যক্তিকে সমালোচনা করার অধিকার দিয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে যে মামলাগুলো হয়েছে, তার প্রায় সবই এই সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ ও সাংবাদিকদের ভীতি প্রদর্শনই যে এই আইন প্রণয়নের মূল লক্ষ্য, সেটি এই আইনের একটি ধারা বিশ্লেষণ করলেই প্রমাণ করা সম্ভব। ধারা ৪২—পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার। এই ধারার উপধারা ১-এ বলা হয়েছে—কোনো পুলিশ অফিসার যদি কারণসহ বিশ্বাস এবং সন্দেহ করেন যে, এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, হচ্ছে কিংবা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে অথবা প্রমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে; তবে তিনি ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবেন। তার ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দ করতে এবং তার দেহ তল্লাশিসহ উক্ত স্থান তল্লাশি করতে পারবেন। বিশ্বাস এবং সন্দেহ—দুটিই বিমূর্ত ধারণা। বিমূর্ত ধারণার ঘাড়ে চেপে কোনো আইন প্রণীত হতে পারে না। ভয়ংকর এবং পেশাদার অপরাধের বেলায় অভিযুক্তের সঙ্গে যা ঘটে—ঠিক সেভাবেই সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও কারাগারে পুরে দেওয়াই এই আইনের মূল লক্ষ্য। অন্যদিকে পুলিশ অফিসার যাকে গ্রেপ্তার করেছে, সেই ব্যক্তিকে দিয়েই তার ডিভাইস আনলক করিয়েছে। বিষয়টি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নিজের বিপক্ষে যায়, এমন কিছু করতে বা বলতে ব্যক্তি বাধ্য নয়।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইনের স্বেচ্ছাচারিতার দোলাচলে সাংবাদিকরা চলে গেছেন সেলফ সেন্সরশিপে। ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশে কোনো ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রচার করতে পারেনি। সিংহভাগ প্রিন্ট এবং অনলাইন পোর্টাল সরকারপন্থি তকমা নিয়ে সার্কুলার চালিয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদী সরকার ভয়ের সংস্কৃতি সফলভাবে চলমান রাখতে পেরেছিল, ফলে রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারের (আরএসএফ) ওয়ার্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে প্রতি বছর প্রেস ফ্রিডম ইস্যুতে বাংলাদেশের অবনমন ঘটেছে। ২০২৪ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৭তম।
অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই গণমাধ্যম, সাংবাদিকতা এবং মুক্ত চিন্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সিএসএ বাতিল করতে হবে। আইসিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে যেসব মামলা করা হয়েছে, তা খারিজ করতে হবে।
আমাদের প্রত্যাশা অংশীজনের সম্পৃক্ততায় এই সরকার এমন একটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করবে, যা বাংলাদেশ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না, বরং সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। ইউএন প্লান অব অ্যাকশনে সাংবাদিকদের জন্য যে গাইডলাইন রয়েছে তা অনুসরণ করবে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক যেসব চুক্তি সই করেছে, সেসব অলঙ্ঘিত থাকবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে।
ড. সৈয়দা আইরিন জামান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলামিস্ট
Comments