দেশজুড়ে হিমালয়সম জঞ্জাল, দূর করতে হবে আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারকে

দেশে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেল। এর দৃশ্যত কোনো কমান্ড কাউন্সিল নেই। গতরাতে শপথ নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধরে নিতে হবে বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল হিসেবে।

১৯৭১ সালের জনযুদ্ধের পর যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল, যেকোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বিশেষ করে বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পর দেশকে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন, সেটা হয়নি। তবে, বাম ধারার রাজনীতিকরা একটা সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব রেখেছিলেন বলে জানা যায়। যদিও সে প্রস্তাব গৃহীত হয়নি।

তখন আমরা স্লোগান দিয়েছি, 'এক নেতা এক দেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ।' তারপর আবার এসেছে, 'এক নেতা এক দেশ খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ।' তারপর আবার 'এক নেতা এক দেশ শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।' অর্থাৎ সবই স্বৈরতান্ত্রিক স্লোগান, এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ওই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অভাবে আমরা কখনো 'আমরা' হতে পারিনি।

বিভিন্ন ট্যাগ দেওয়ার সংস্কৃতিও একটা স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি পূর্ব বাংলার ন্যায্য অধিকারের আন্দোলন যখনই তীব্র হয়েছে, তখনই পাকিস্তানি শাসকরা আমাদেরকে ট্যাগ দিত 'ভারতীয় দালাল' বলে। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলেই ট্যাগ দেওয়া হয়েছে 'রাজাকার' বলে, বিএনপির সামান্য সমালোচনা হলেই ট্যাগ করা হয় 'বাকশাল হিসেবে'—এ ধরনের চরিত্র কখনো গণতান্ত্রিক হতে পারে না।

সম্প্রতি ফ্যাসিস্ট একনায়ক শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর দেশজুড়ে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা একাই পালিয়েছেন, রেখে গেছেন তার দল, দলের পেটোয়া বাহিনী।

তার সময়ে সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে যে, এই নতুন অর্জনকে ম্লান করে দিতে আওয়ামী ষড়যন্ত্র চলছেই। সারাদেশে আজও পুলিশ নেই। আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতির পেছনে পুলিশের অনুপস্থিতি ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ভারতীয় মিডিয়ার ক্রমাগত মিথ্যা নিউজ এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করছে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশও ঘোষণা দিয়েছে এসব গুজবে কান না দিতে।

গতকাল আবার শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ভিডিওবার্তায় বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো নির্বাচনই বাংলাদেশে সম্ভব হবে না। তারাও নাকি আলোচনায় বসতে চান। আগে একবার বললেন, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। পরেই আবার মত পালটে বললেন, একমাত্র শেখ হাসিনাই পারেন বাংলাদেশকে রক্ষা করতে।

এই নতুন বাংলাদেশ নিয়ে যথেষ্ট ষড়যন্ত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। সরকারি কর্মচারীরা যারা এত বেশি আনুকূল্য পেয়েছেন এত বছর, তারাও অসহযোগিতা করছে।

বিগত সরকারগুলোর—শুধু আওয়ামী লীগ সরকার নয়, তার আগের সরকারগুলোর আবর্জনা দূর করতে যথেষ্ট সময় লাগবে। বিগত সরকারগুলোর আবর্জনা জমে জমে হিমালয় পর্বতসম জঞ্জাল তৈরি হয়েছে।

অবশেষে নতুন করে অভ্যুত্থান হয়েছে। এখানে 'আমি'র চাইতে 'আমরা' প্রাধান্য পেয়েছে। আশা করি, নতুন এই অন্তর্বর্তী সরকার সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হবে, 'আমি'তে ডুবে যাবে না, 'আমরা' হয়ে দেশ পরিচালনা করবে। কম করে হলেও চার বছর তাদের ক্ষমতায় থাকতে হবে, না হলে এতদিনের জঞ্জাল চুল পরিমাণও সরাতে পারবে না।

বিগত সরকারগুলো এমনভাবে দলীয়করণ করেছে যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ, ডাক্তার—কেউই সাধারণ মানুষকে পাত্তা দেয়নি। তাদের কাছে দেশের চাইতে দল বড় ও দলের চাইতে ব্যক্তি বড় ছিল। এ অবস্থার পরিবর্তন খুব সহজে সম্ভব হবে না।

ইতোমধ্যে মাখন খাওয়ার লাইন পড়ে গেছে। অপাঙ্‌ক্তেয় সব রাজনৈতিক দল দাবি জানানো শুরু করেছে তিন মাসের মধ্য নির্বাচন দিতে। অর্থাৎ তারাই যেন এই নাজুক অবস্থার সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারে এবং আওয়ামী লীগের মতো ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারে।

সুতরাং, অবশ্যই সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে—মানুষের জন্য সংবিধান, সংবিধানের জন্য মানুষ না। দেশপ্রেম, ন্যায্যতা আর সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় সমতার ভিত্তিতে তরুণদের নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা যেতে পারে এবং তাদের সময় দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। এটাই এই প্রজন্মের, এ সময়ের জনতার চাওয়া।

তবে, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই দেশে আসতে হবে। সব রকমের গুম, খুন, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র আন্দোলনের সময় ছয় বছরের শিশুসহ সাড়ে তিনশর বেশি ছাত্র-শ্রমিক-জনতা হত্যার বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে।

মাসুম বাসার: অভিনয়শিল্পী

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

6h ago