আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ বিস্ফোরণ

আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ বিস্ফোরণ

২০২৪ সালের ২১ জুলাই এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন বাংলাদেশে অভূতপূর্ব সব ঘটনা ঘটছে। দেশজুড়ে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ; মানুষ ঘরবন্দি; ইন্টারনেট সেবা বন্ধ; সরকারি ছুটি চলছে; গুলিতে মানুষ মরছে; মরছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও। পুড়ছে গাড়ি-বাড়ি, সরকারি স্থাপনা। আর অকল্পনীয় এক সহিংসতায় আতঙ্কিত দেশের মানুষ।

এদিকে তীব্র এই প্রতিবাদে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে শক্তিশালী রাজনৈতিক ন্যারেটিভ। যে ন্যারেটিভের গ্রহণযোগ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কত সময় লাগবে তা একমাত্র সময়ই বলতে পারে।

ক্রমাগত জনমত ও জনআকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করা, দিবারাত্রি যাকে-তাকে রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দেওয়া প্রবল প্রতাপশালীদের কেন এই কোণঠাসা অবস্থা?

এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ হতে পারে। সবই কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র, নাকি এর পেছনে কারো অর্বাচীন শব্দচয়ন আর অনাকাঙ্ক্ষিত দম্ভ জড়িত—রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ ও গুণীজনরা তা বিবেচনা করবেন। দায়ীদের দোষ ও দায় নির্ধারণ করবেন।

আমি সেদিকে যেতে চাই না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি নগণ্য সাবেক এক শিক্ষার্থী হিসেবে আমি অন্য একটি বিষয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। যে কথা আমার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিয়ে।

এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে থাকেন। আসলে কোনোকালেই এটা এমন ছিল না। মান ও গুণ বিবেচনায় অক্সফোর্ডের ধারেকাছেও নেই এই প্রতিষ্ঠান, কোনো দিন ছিলও না।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিমা, গর্ব ও গৌরব অন্য জায়গায়। এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যা একটি জাতির জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা একটি জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়েছে। আর শেষ কথায় এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে একটি জাতির চূড়ান্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি দখলদার, হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্তে অঙ্কিত হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র। যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল, অনন্য।

বায়ান্ন, উনসত্তর, একাত্তর, নব্বইয়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সব সময়ই এক অন্য রকম গৌরব বহন করে। এই গৌরব ফাঁপা বুলি নয়। রক্তের দামে অর্জিত। ন্যায়ের মানদণ্ডে পরীক্ষিত। যে কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মনে করা হয় সব ধরনের অন্যায়, অনাচার, শোষণ ও কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের তীর্থভূমি। যে কারণে এই ক্যাম্পাসকে সব সময়ই সংবেদনশীলভাবে বিবেচনা করেছেন ক্ষমতাসীনরা।

কিন্তু ২০২৪ সালের ১৫ ও ১৬ জুলাই ক্ষমতাসীনরা এই ক্যাম্পাসে যা করল, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। অকল্পনীয় পর্যায়ের মূর্খতা, রাজনৈতিক বিপর্যয়, আত্মঘাতী। ঘোষণা দিয়ে আত্মবিনাশী এমন কাজ বাংলাদেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দল আগে করেছে কি না—তা খুঁজে বের করা মুশকিল।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছেন, তাদের শায়েস্তা করবে অনুগত ছাত্র সংগঠন—গণমাধ্যমে দলের দ্বিতীয় প্রধানের প্রকাশ্যে এমন গুরুতর উসকানির পর শহীদের রক্তে ভেজা ক্যাম্পাসে অভূতপূর্ব এক তাণ্ডব চালানো হলো। অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে বিশ্ববাসী দেখল চ্যালা কাঠ, লাঠি, রামদা, চাপাতি হাতে একদল দুষ্কৃতিকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নির্মমভাবে পেটাচ্ছে। এই নিষ্ঠুর নির্যাতনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে হেলমেটধারীরা, পুরান ঢাকা থেকে আসা টোকাই আর টেন্ডারবাজ অস্ত্রধারী।

হামলাকারীদের বেদম পিটুনিতে রক্তাক্ত নারী শিক্ষার্থী তানিয়া আক্তার মীম লাঠিতে ভর দিয়ে পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। অন্য নারী শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে পিটিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের টোকাইরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের ছাত্র সংগঠনের অস্ত্রধারীরা পিটিয়ে রক্তাক্ত করছে! এর চাইতে নিদারুণ দৃশ্য আর কী হতে পারে!

এখানেই শেষ নয়, পরের দিকে হামলাকারীরা পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের দিকে গুলি ছুড়েছে। কী ভয়াবহ দৃশ্য! রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীর নিরপেক্ষতা আজ কোথায়? আপনার-আমার করের টাকায় এই পুলিশ সদস্যদের বেতন হয়—যারা প্রকাশ্যে অস্ত্রধারীদের আস্কারা দিলেন। আর পরদিন ১৬ জুলাই মেরেপিটে নিজের ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থীদের তাড়িয়ে দিলো পুলিশ, বিজিবি।

দলের শীর্ষ নেতার উসকানি ও নির্দেশনায় হেলমেটধারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তা কি খুব সহজে এই শিক্ষার্থীদের মন থেকে মুছে যাবে? এ ছাড়া, এরই সূত্র ধরে পরের দিনগুলোতে যে প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটল, সবাই কি তা একদিনে ভুলে যাবে? খুব সম্ভবত না। বরং রাজনীতিতে এই ভুলের মাসুল দীর্ঘদিন ধরে দিতে হবে।

বর্তমান বিরোধী দল বিএনপি যেমন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কাফফারা এখনো দিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি এই ছাত্র নির্যাতন ও হত্যার জের হয়তো কাউকে না কাউকে দীর্ঘদিন বহন করতে হবে। তানিয়া আক্তার মীমের রক্তাক্ত মুখ বহুদিন স্বপ্নের মধ্যে অনেককেই তাড়িয়ে বেড়াবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে টোকাই ও হেলমেটধারী দুষ্কৃতিকারীদের বর্বর আক্রমণের প্রেক্ষাপটে লেখক, সাংবাদিক আহমদ ছফার কথা মনে পড়ছে। ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে লেখা একটি নিবন্ধে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উল্লেখ করেছিলেন বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ হিসেবে।

২০২৪ সালে এই জ্বালামুখে যে রাজনৈতিক অপরিপক্কতার, অদূরদর্শীতার পরিচয় দিলো, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। জ্বালামুখ বিস্ফোরণের ফলাফল যে কী—তা ইতোমধ্যেই সবাই অবগত হয়েছেন। যাতে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ২০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন (প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৪)। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। একজন পুলিশ সদস্যের সন্তান সীমাহীন নিষ্ঠুরতার বলি হয়েছেন। কত শত কোটি টাকার সম্পদ যে নষ্ট হয়েছে, তার হিসেব বের করাও কঠিন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখে যে অসংবেদনশীল, অর্বাচীন, প্রজ্ঞাহীন সহিংস আচরণ করা হয়েছে—এর জের দীর্ঘদিন টানতে হবে। খুব সম্ভবত এক সময় কাউকে না কাউকে এর হিসাব দিতে হবে কড়ায়-গণ্ডায়।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

BB tightens loan classification rules to meet IMF conditions

Payment failure for three months or 90 days after the due date will now lead to classification of loans regardless of type, according to new rules announced by the central bank yesterday, aligning with international best practices prescribed by the International Monetary Fund (IMF).

4h ago