কোটা নিয়ে ‘কটু’ কথা

কোটা নিয়ে কথা বলা কঠিন। খানিকটা বিপদজনকও। যুক্তি যতই শাণিত হোক না কেন, এতে 'সরকারি-বিরোধী', 'স্বাধীনতা-বিরোধী' এমনকি 'জামাত-শিবির' ট্যাগ লাগার সম্ভাবনা প্রবল। যে কারণে দেশের বেশিরভাগ বিবেকবান বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ মোটামুটি চুপ। কিন্তু চোখ বন্ধ রাখলেই প্রলয় বন্ধ হয় না। কোটা পুনর্বহালে হাইকোর্টের রায় ঘোষিত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের যে উদগীরণ, তা উপেক্ষা করা কঠিন। বিষয়টি অতি সংবেদনশীল ও জনসমর্থনযুক্ত হওয়ায় সরকারও শক্তি প্রয়োগ করতে সময় নিচ্ছে। এই সময় কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি, যা অনেকের কাছেই 'কটু' কথা বলে মনে হতে পারে।

সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে মতলবি মন্তব্য ও বাগাড়ম্বর সর্বস্ব বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে বাস্তববাদী হওয়া প্রয়োজন। হ্যাঁ, আমি হলফ করে বলছি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের রক্তে এদেশের পলিমাটি রঞ্জিত। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আহত, গুরুতর অঙ্গহানির শিকার। তাদের সন্তানদের জন্য অবশ্যই কোটা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু সেটা হতে হবে যৌক্তিক পর্যায়ের। চাকরিতে তাদের সুবিধা নিশ্চিত করতে গিয়ে মেধাবী, পরিশ্রমী ও যোগ্যদের যাতে বঞ্চিত করা না হয়, সে বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমান কোটা কাঠামো যদি মেধাবীদের প্রতিযোগিতায় হতাশ ও নিরুৎসাহিত করে, তাহলে সেটাও আমলে আনা প্রয়োজন। মনে রাখা প্রয়োজন বিদ্যমান কাঠামো যদি অধিক হারে কম মেধাবী ও অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করে, তাহলে কিন্তু দিন শেষে ক্ষতি এই রাষ্ট্রের। এতে নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আগামীতেও হবে।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কাঠামো বাস্তবতায় একটি সরকারি চাকরি রীতিমতো 'সোনার হরিণ'। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীরা এই হরিণের পেছনে ছোটেন। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাকে পাশ কাটিয়ে তাদের মূল আগ্রহ থাকে চাকরির কোচিংসহ অন্যান্য গাইড বই ও লেকচারের প্রতি। বিষয়টি দৃষ্টিকটু হলেও তাদের দোষারোপ করা যায় না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে একজন শিক্ষার্থী মেধাবলে গবেষক হবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হবেন—এই নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে। এরমধ্যেও যে কত যাদুমন্ত্রের ঘণচক্কর আছে, তা এখনে আলোচনা প্রাসঙ্গিক নয়।

যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যখন শিক্ষার্থীরা চাকরি বাজারে নামছেন, তখন দেখছেন তাদের জন্য চরম বৈষম্যমূলক একটি কোটা পদ্ধতি বিদ্যমান। সরকারি চাকরি, বিশেষ করে বিসিএসে ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য। এতে চাকরিপ্রার্থীরা নিজেদের অধিকারবঞ্চিত মনে করছেন। আমি মনে করি বিদ্যমান কাঠামোয় তাদের সংক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে সাম্য, সুযোগের সমতা ও বৈষম্যহীনতা। একটু পেছন ফিরে ১৯৭১ সালে গেলে আমরা এই সম অধিকারের দৃপ্ত উচ্চারণ শুনতে পাই। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের যে ঘোষণাপত্র তুলে ধরা হয়েছিল, তার মূল কথা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ ও সব মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটাতে সাম্য ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হচ্ছে কি না, বিষয়টি নতুন করে চিন্তার সুযোগ আছে।

আগেই উল্লেখ করেছি কোটা নিয়ে আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত কোনো কার্যকর ফল বয়ে নিয়ে আসবে না। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য অবশ্যই কোটা বহাল রাখতে হবে। কিন্তু তা হতে হবে যৌক্তিক পর্যায়ের। এর জন্য কমিশন গঠন করে আলোচনার প্রয়োজন। সুচিন্তিত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যাতে সবার জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হয়।

কয়েকদিন আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে যে আন্দোলন, তাতে সরকার-বিরোধী বেশ কিছু ছাত্র সংগঠনের যোগসূত্র আছে।

কথা হচ্ছে, আন্দোলনের দাবি যদি যৌক্তিক হয়, তাহলে কোনো বৈধ ছাত্র সংগঠনের জন্য সেই আন্দোলন করা, সক্রিয়ভাবে অংশ করা কি আইনের লঙ্ঘন? মনে হয় না। আমার বিশ্লেষণে কোটা আন্দোলনে সবচেয়ে বিপাকে আছে সরকার-সমর্থক ছাত্র সংগঠন। এক সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর তারা চড়াও হয়েছেন। নিষ্ঠুরভাবে জনসম্মুখে আন্দোলনকারীদের পিটিয়েছেন। আবার কোটা বাতিল হওয়ার পর তারাই করেছেন আনন্দ মিছিল।

জীবন ও পারিবারিক আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টায় থাকা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ দিন ধরেই অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক কোটা-ব্যবস্থার শিকার। এতে দিনে দিনে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা পুঞ্জীভূত হয়েছে। যার লাভা ছড়িয়ে পড়েছিল ২০১৬ সালে। ২০২৪ সালে এই ক্ষোভ ধ্বংসাত্মক রূপ নেওয়ার আগেই একটি কমিশন গঠন করে কোটা-ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। মনে রাখা প্রয়োজন, আইন পবিত্র কোরআন বা বাইবেল নয়। প্রয়োজন অনুযায়ী সংবিধানে পরিবর্তন আনাই কাম্য, এটাই উন্নত সভ্যতার পরিচায়ক।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
NID cards of Sheikh Hasina and family locked

NIDs of Hasina, 9 family members 'locked'

The NIDs of the 10 listed individuals were locked through an official letter on April 16

1h ago