হেফাজতে মৃত্যু মানেই ‘হার্ট অ্যাটাক’ কেন?

নাগরিকের সুরক্ষা এবং অপরাধীর শাস্তি তথা অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন কতটুকু সহায়ক হবে, সেটি পুরোপুরি নির্ভর করে আইনের প্রয়োগকারীদের ইনটেনশন বা উদ্দেশ্য এবং সেই আইনটি বাস্তবায়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্তের ওপর।

সম্প্রতি যশোরের অভয়নগরে থানা হেফাজতে এক নারীর মৃত্যুর পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আফরোজা বেগম নামে ওই নারীর 'কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট' হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, আফরোজা বেগমকে গ্রেপ্তারের সময় তার কাছে ৩০টি ইয়াবা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, পুলিশের দাবি অনুযায়ী ওই নারী 'মাদক ব্যবসায়ী'।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, গ্রেপ্তারের পর তাকে অভয়নগর থানা হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকালে থানা হাজতে থাকা অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং এরপর যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

প্রশ্ন হলো—পুলিশ গ্রেপ্তার করার পরে কী এমন ঘটনা ঘটলো যে তাকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং এরপর জেলা হাসপাতালে নিয়েও বাঁচানো গেল না? পুলিশের দাবি অনুযায়ী যদি তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন হলো তিনি কি আগে থেকেই হার্টের রোগী ছিলেন? তার পরিবার কী বলছে? এই ঘটনার কি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হবে, নাকি পুলিশের দাবি অনুযায়ী ওই নারী 'মাদক ব্যবসায়ী' ছিলেন বলে তার মৃত্যুটিকে ‌'জায়েজ' বলে ধরে নেওয়া হবে?

আফরোজা বেগমের স্বজনদের অভিযোগ, ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে গ্রেপ্তারের পর তার ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। বাড়িতে থাকা অবস্থায় পুলিশ তাকে মারধর করেছে। এমনকি ঘরের ফ্যানের সঙ্গে তার চুল বেঁধেও নির্যাতন করেছে।

এই মৃত্যুর ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগ (সুয়োমোটো) গ্রহণ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি)। এই ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে আগামী ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কমিশনের সুয়োমোটোতে বলা হয়েছে, পুলিশের কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে থানায় নিয়ে একজন নারীকে চুল ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন ও পরবর্তীতে ওই নারীর মৃত্যু সংক্রান্ত অভিযোগটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের এমন অপেশাদারি ও দায়িত্বহীন আচরণে দেশে-বিদেশে পুরো বাহিনীর কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন। (ডেইলি স্টার বাংলা, ০৫ জুন ২০২৪)

এই ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পক্ষ থেকেও উদ্বেগ জানিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়েছে।

পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনা তদন্তে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে (প্রশাসন ও অর্থ) প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও যে প্রশ্নটি বহু বছর ধরেই জনগণ ও অ্যাকাডেমিক পরিসরে আছে সেটি হলো, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত যখন পুলিশ নিজেই করে, সেটি কতটা নির্মোহ-নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত রাখা সম্ভব? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে যত লোকের মৃত্যু হয়েছে—তাতে তিনি যেই হোন না কেন, কতটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে? কতটি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যরা অভিযুক্ত হয়েছেন? কতজনের বিচার হয়েছে? কতটি ভুক্তভোগী পরিবার আইনশৃঙ্খলা কিংবা কোনো গোয়েন্দা বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পায়? মামলা করার পরে তাদেরকে কী ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়? পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা চালানো কি খুব সহজ? রাষ্ট্র কি এইসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দেয়?

বলা হয়, পুলিশের রোষানলে কেউ পড়লে তার নিজের জীবন তো বটেই, পুরো পরিবারও তছনছ হয়ে যায়। একটি বাহিনী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে যে এই পারসেপশন তৈরি হলো, সেরকম পরিস্থিতিতে এই বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ উঠলেও সেই অভিযোগটি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ের করে এর শেষ দেখার সাহস, ধৈর্য, আর্থিক ও সামাজিক সক্ষমতা কতজনের রয়েছে? বিশেষ করে রাজনৈতিক বিভিন্ন মামলায় আটক বা গ্রেপ্তার হওয়ার পরে যারা হেফাজতে নির্যাতনে মারা গেছেন, সেসব নিহতের পরিবারের পক্ষে এই ধরনের অভিযোগ দায়ের করে অপরাধ প্রমাণ করা আরও কঠিন।

এই মুহূর্তে যে প্রশ্নটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক সেটি হলো, হেফাজতে মৃত্যুর পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে সেগুলোকে হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলে দাবি করা হয়? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পরেই তারা হার্ট অ্যাটাক করেন নাকি তাদের হার্টে অসুখ তৈরি হয়? নাকি পুলিশ বেছে বেছে এমন লোকদেরই ধরে যাদের হার্টের অসুখ আছে? নাকি হেফাজতে মৃত্যুবরণকারী অধিকাংশই যে হার্টের রোগী—সেটি ‌কোইনসিডেন্স? প্রশ্নগুলো সহজ। কিন্তু উত্তর জানা নেই।

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক:

১. থানায় 'নির্যাতনে' মৃত্যু, পুলিশের দাবি হার্ট অ্যাটাক: ডেইলি স্টার বাংলা, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

২. নির্যাতনে ব্যবসায়ীর মৃত্যুর অভিযোগ, পুলিশ বলছে 'ভয়ে হার্ট অ্যাটাক': বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৭ নভেম্বর ২০২৩

৩. বগুড়ায় ডিবি হেফাজতে মৃত্যু-ময়নাতদন্তে হার্ট অ্যাটাকের তথ্য: আজকের পত্রিকা, ২১ অক্টোবর ২০২৩

৪. পুলিশ হেফাজতে দুদকের সাবেক উপপরিচালকের মৃত্যু, পরিবারের দাবি হত্যা: দৈনিক বাংলা, ৪ অক্টোবর ২০২৩

৫. অভিযানে নিয়ে যাওয়া সাক্ষীর মৃত্যু, পুলিশ বলছে হার্ট অ্যাটাক: ঢাকা পোস্ট, ০৯ ডিসেম্বর ২০২২

৬. হেফাজতে যুবকের মৃত্যু, 'গণপিটুনিতে হার্ট অ্যাটাক' দাবি পুলিশের: সারা বাংলা ডটনেট, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

চলতি বছরের শুরুর দিকে পুরান ঢাকার একজন বডিবিল্ডার পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়ার পরে পুলিশের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ আনেন তার স্ত্রী। গত ৩ ফেব্রুয়ারি একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশ তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ চেয়েছে। না হলে পুলিশকে খুশি করতে বলেছে। পুলিশ কীভাবে খুশি হতে চেয়েছে বা ওই ভুক্তভোগী নারীকে পুলিশ কী বোঝাতে চেয়েছে—সেটি খুলে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি ওই নারীর অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে এটি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এটি নিরাপত্তা হেফাজতে কাউকে মেরে ফেলার চেয়ে কম অপরাধ নয়। প্রশ্ন হলো, এই ঘটনার কি সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে বা হচ্ছে? দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এখানেও পুলিশ ফারুক নামে ওই বডিবিল্ডারকে 'মাদক ব্যবসায়ী' বলে দাবি করলেও পরিবারের অভিযোগ, পকেটে গাঁজা দিয়ে পুলিশ তাকে ফাঁসিয়েছে।

পকেটে ইয়াবা বা এরকম মাদক নিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে এর আগেও উঠেছে। যাদের এরকম মাদক দিয়ে ধরা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো প্রকৃতই মাদক ব্যবসায়ী। তথ্য-প্রমাণের অভাবে ধরা কঠিন বলে পুলিশ কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীর পকেটে মাদক দিয়ে তাদের আটক করে—এরকম কথাও শোনা যায়। কিন্তু যাদের এভাবে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের সবাই কি মাদক ব্যবসায়ী? পুলিশ কি সবসময় মাদক দমনের অংশ হিসেবে এ ধরনের আটক করে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে?

ধরা যাক আফরোজা মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু তারপরও তাকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের অধিকার পুলিশের আছে কি না? তথ্য আদায়ের জন্য পুলিশ আসামি বা সন্দেহভাজনদের মারধর করে, সেটি সবাই জানে। কিন্তু সেই নির্যাতনে যদি কারো মৃত্যু হয়ে যায়, তখন সেটি আইনত অপরাধ এবং ওই অপরাধ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু এই ধরনের অপরাধে কতজন পুলিশের শাস্তি হয়েছে বা শেষ পর্যন্ত কতজনের অপরাধ প্রমাণ করা যায়?

২০১৩ সালে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন সংসদে পাস হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গত ১১ বছরে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু কি বন্ধ হয়েছে? যদি বন্ধ না হয়, তাহলে এই আইনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কয়টি মামলা হয়েছে? সেই মামলার পরিণতিই বা কী? এরকম একটি কঠোর আইন থাকার পরেও কেন হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধ হচ্ছে না? রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সংস্থাগুলো কি এই আইন পাত্তা দিচ্ছে না, নাকি অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া তথা সুরক্ষার নিশ্চয়তা রয়েছে বলে তারা আইনের তোয়াক্কা করছে না?

অন্যান্য আইনে যেমন ভুক্তভোগী নিজে অথবা তার পরিবারকে মামলা করতে হয়, এই আইনে সেই বিধানও শিথিল। অর্থাৎ রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক আদালতে এই অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন যে অমুককে হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে।

এই আইনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি অপরাধ করেননি। ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো সরকারি কর্মকর্তা অথবা তাহার পক্ষে কর্তব্যরত কোনো ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে অভিযোগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হইলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করিতে হইবে যে, তাহার বা তাহার পক্ষে কর্তব্যরত ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে ওই ক্ষতি হয় নাই।'

বাস্তবতা হলো, এরকম একটি জনবান্ধব আইন থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। কারণ, একবার কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হলে, পরবর্তী হয়রানির ভয়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা পরিবার আইনের আশ্রয় নিতে চায় না। রাষ্ট্র তাকে সেই সুরক্ষাও দিতে পারে না। উপরন্তু সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত এবং বিচারিক প্রক্রিয়াটি যেরকম পক্ষপাতদুষ্ট, তাতে কতটি অপরাধ প্রমাণ করা যায়—তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।

মোদ্দা কথা, একটি ভালো আইন থাকা মানেই যে তার দ্বারা দেশের সাধারণ মানুষ খুব সুরক্ষিত থাকবে এবং অপরাধী যেই হোক তার বিচার হবে—বিষয়টা এত সহজ নয়। কেননা নাগরিকের সুরক্ষা এবং অপরাধীর শাস্তি তথা অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে ওই আইনটি কতটুকু সহায়ক হবে, সেটি পুরোপুরি নির্ভর করে আইনের প্রয়োগকারীদের ইনটেনশন বা উদ্দেশ্য এবং সেই আইনটি বাস্তবায়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্তের ওপর।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments